ঘুরে এলাম টেরাকোটার পীঠস্থান “পাঁচমুড়া”
আমার কথা, বাঁকুড়া, ৮ জানুয়ারি:
প্রতিবেদক : প্রণয় রায়
আজকের খবরের কাগজে দেখলাম বড়জোড়ার ফুলবেড়িয়া গ্রামে গত পরশু রাতে দুটো দাঁতাল হাতি হানা দেয়। অথচ গতকাল রাতেই আমরা সেই গ্রামের পাশের হাড় হিম করা নির্জন গভীর জঙ্গলের পথে প্রাণ হাতে করে বেলিয়াতোড় থেকে বড়জোড়া আসি। এখন সে কথা নয়। বরং চলুন টেরাকোটার গ্রাম বাঁকুড়ার তালডাংড়ার পাঁচমুড়া গ্রাম থেকে ঘুরে আসি।
খুব সকালে আমরা বেরিয়ে দুর্গাপুর ব্যারেজ ছাড়িয়ে বড়জোড়া হয়ে বেলিয়াতোড় এসে পৌঁছালাম। লালুর দোকানের গরম গরম চা খেয়ে বেলিয়াতোড়ের বিখ্যাত মেচা মহলের মেচা সন্দেশ খেলাম। এরপর চললাম পাঁচমুড়ার নব বৃন্দাবন মন্দির ও সেখানকার টেরাকোটার কাজ দেখতে টেরাকোটার শিল্পীদের গ্রামে। বাঁকুড়ার বাইপাস হয়ে ধলডাঙার মোড় থেকে শিবপুর হয়ে তালডাংড়ার পথ ধরলাম। পথের দুপাশে সর্ষে ক্ষেত ও আলুর ক্ষেত। একসময় এসে পৌঁছালাম পাঁচমুড়া। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় ঝাঁকুনি খেতে খেতে পাঁচমুড়ায় পৌঁছাতে একটু দেরী হয়ে গেল। পাঁচমুড়ায় ঢুকতেই টেরাকোটার দেশ হিসেবে বিখ্যাত পাঁচমুড়ায় রাস্তার ধারেই চোখে পড়ল বৃন্দাবনের ধাঁচে বিশাল রাধাকৃষ্ণের মন্দির নব বৃন্দাবন। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে স্থানীয় স্বচ্ছল ব্যবসায়ী ভজন দত্ত বৃন্দাবন ঘুরে আসার পর তাঁর মনোবাসনা হয় পাঁচমুড়ায় যদি বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণর মন্দিরের ধাঁচে একটা মন্দির তৈরী করা যায়। যেমনি ভাবনা তেমনি কাজ। অর্থের অভাব হল না। তখন থেকে বিশাল মন্দির নির্মানের কাজ শুরু হল। প্রায় দশ বছরের চেষ্টায় গড়ে উঠল বৃন্দাবনের ধাঁচে বিশাল ত্রিনাথ মিলন মন্দির বা নব বৃন্দাবন মন্দির। গত বছর দোল যাত্রার দিন এই মন্দিরের উদ্বোধন হয়। সারা মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে রাধাকৃষ্ণের বিভিন্ন মূর্তি ও শ্রীকৃষ্ণের নানা লীলাকথা খোদিত। অপূর্ব সুষমামণ্ডিত এই মন্দিরে প্রতিদিন দুপুরে অসংখ্য ভক্ত অন্ন ভোগ পান। এর জন্য জন প্রতি
ষাট টাকার কুপন কাটতে হয়। এই মন্দিরটি বাঁকুড়া জেলার অত্যন্ত দর্শনীয় স্থান। পাশেই পাঁচমুড়ার টেরাকোটার মূর্তি গড়ার শিল্পীদের গ্রাম।
আজ মন্দির জুড়ে ছিল ভীষণ ভীড়। প্রসাদ খাবার বিরাট লাইন থাকায় আমরা স্থানীয় একটা হোটেলে এখানকার চাষের মোটা চালের সুস্বাদু ভাত, আলু পোস্ত, আলু কুমড়োর তরকারি,ডাল, মাছ চাটনি ও পাপড় ভাজা খেয়ে টেরাকোটার শিল্পীদের গ্রাম দেখতে বের হলাম। গ্রামে পরপর বাড়িতে মাটি দিয়ে তৈরী হচ্ছে ঘোড়া, হাতি, বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। কাঁচা মাটির মূর্তিগুলো তৈরী করে শুকিয়ে তা বিরাট একটা চুল্লিতে পর পর সাজিয়ে কয়লার আগুনে পোড়ানো হচ্ছিল। আলাপ হল চন্ডীদাস কুম্ভকারের সঙ্গে। ওনার বাড়িটাই ওদের পোড়ামাটির মূর্তি তৈরীর কারখানা। তিনি প্রয়াত রাসবিহারী কুম্ভকার এর দৌহিত্র। প্রয়াত রাসবিহারী ছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত টেরাকোটা শিল্পী। তিনি তদানীন্তন ভারতের রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেনের হাত থেকে ১৯৬৯ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার গ্রহণ করেন। আলাপ হল প্রয়াত রাসবিহারী কুম্ভকারের পুত্র পশুপতি কুম্ভকারের সঙ্গে।
তার বাবা রাসবিহারীর হাত ধরে তিনি বংশ পরম্পরায়ের এই পারিবারিক টেরাকোটার শিল্পকর্মে আসেন। পশুপতি কুম্ভকারের দুই পুত্র চন্ডীদাস কুম্ভকার ও বাউলদাস কুম্ভকার। বাউলদাস কুম্ভকার ২০০৪ সালে আমেরিকার হনলুলুতে এক ওয়ার্কশপে আমন্ত্রণ পেয়ে সেখানে টেরাকোটার পোড়া মাটির ঘোড়া হাতি কিভাবে তৈরী করতে হয় তার ওয়ার্কশপে আমন্ত্রণ পেয়ে যান। তিনি রাশিয়াতেও টেরাকোটার কাজ শেখানোর আমন্ত্রণ পেয়ে ছিলেন।
এখন প্রত্যেক ভাই এর একই বাড়িতে আলাদা আলাদা মূর্তি তৈরীর কারখানা। আলাপ হল ওদের আত্মীয় নারায়ন কুম্ভকারের সঙ্গে। উনিও ওনার ওয়ার্কশপ ঘুরে ঘুরে দেখালেন।
চন্ডীদাস কুম্ভকার ও তার স্ত্রী মঞ্জুশ্রী কুম্ভকার দেখালেন তাদের তৈরী বিভিন্ন শিল্পকর্ম। মঞ্জুশ্রী বোঝালেন কিভাবে তারা পোড়ামাটির মূর্তি তৈরী করেন। তিনি বললেন মাটির সঙ্গে কিছুটা বালির মিশ্রণ করে তা জলে ভিজিয়ে ভালো করে মিশ্রন তৈরী করা হয় পায়ে মাড়িয়ে। এটা বেশ পরিশ্রমের কাজ। মাটির নরম তাল করে রাখা হয়। এরপর এ দিয়ে তৈরি করা হয় ছোট বড় মাঝারি আকারের ঘোড়া, হাতি ও অন্যান্য দ্রব্য। বড় গুলো তৈরি করা হয় ধাপে ধাপে। ছোট মূর্তিগুলো তৈরি করা হয় ছাঁচে ঢেলে ।
চন্ডীদাসবাবু বললেন এরপর রোদে শুকিয়ে রঙ মাটির গাদ তৈরী করে ন্যাকরা ভিজিয়ে সেই গাদ মূর্তিগুলোতে লাগানো হয়। তা শুকিয়ে যাবার পর আবার বনক মাটির রঙ সেই মূর্তিগুলিতে দ্বিতীয়বার ন্যাকরা ভিজিয়ে লাগানো হয়। এরপর বিরাট ভাটির মধ্যে সেই মূর্তিগুলো সাজিয়ে কয়লার আঁচে সাত থেকে আটঘন্টা পোড়ানো হয়। এরপর মূর্তিগুলো অর্ডার অনুযায়ী বিক্রি করা হয়।
ওদের তৈরী পোড়ামাটির বিভিন্ন মূর্তির চাহিদা দেশে বিদেশে সর্বত্র। বংশ পরম্পরায় পাঁচমুড়া গ্রামের সব কুম্ভকার পরিবার এভাবে টেরাকোটার মূর্তি তৈরী করছেন যার কদর দেশ বিদেশ সর্বত্র।
ফেরার সময় নারায়ণ কুম্ভকার বলেন তাদের পরিশ্রমের ফসল নানা হাত ঘুরে প্রচুর দামে বিক্রি হয় দেশ বিদেশ সর্বত্র কিন্তু তারা সে লাভের কড়ির পুরোটা কোনদিনও পান না।
একটু একটু করে বিকেল নামছিল। চারধারে হিমেল হাওয়ার পরশ। আমরা দুর্গাপুর ফেরার পথ ধরলাম। আমরা যাবার সময় বাঁকুড়া হয়ে ধলডাঙা হয়ে শিবডাঙার মোড় হয়ে তালডাংড়ার পথ ধরেছিলাম। এই রাস্তাটি পাঁচমুড়া যাবার কিছুটা সংক্ষিপ্ত পথ হলেও রাস্তাটির সংস্কার হচ্ছে বলে যাতায়াতের পক্ষে খুবই অযোগ্য তাই ফেরার পথে বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া হয়ে বেলিয়াতোড় পেরিয়ে দুর্গাপুরের পথ ধরলাম।