আইপিএল ব্যবসায়ীরা ক্রিকেটারদের চাকর মনে করেন, কোনো সম্মান করে নাঃ কীর্তি
আমার কথা, বিশেষ প্রতিবেদন, ১৭ মার্চঃ
বাবা মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তাই প্রচুর চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে চলতে হয়েছে। দিল্লি ক্রিকেট বোর্ডের কর্তা থাকাকালীনও তাঁকে ঘিরে ছিল বিতর্ক, রাজনীতির ময়দানে নেমেও যুঝতে হচ্ছে বিতর্কের সাথে। ১৯৮৩র বিশ্বকাপে লর্ডসের মাটিতে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সেই ঐতিহাসিক জয় আর সেই দলেরই সদস্য ছিলেন মারকুটে অলরাউন্ডার কীর্তি আজাদ। তাঁর সাথে ক্রিকেট নিয়ে একান্ত আলাপচারিতায় ‘সময়ের ধ্বনি’-র সম্পাদক মুনমুন দত্ত
প্রশ্নঃ ৮৩ সালের ২৫ জুন, সেই দিনটি কেমন ছিল সেই মুহূর্তের কি অনুভূতি আপনার কাছে?
উত্তরঃ সেই দিনটি আমার কাছে আজও যেন জীবন্ত। এখনও সেই দিনটি আর সেই মুহূর্তটির প্রসঙ্গ উঠলে আমি নস্টালজিক হয়ে পড়ি। এখনও আমার গায়ে কাঁটা দেয় যেন। অত্যন্ত খুশীর দিন ছিল আমাদের সকলের জন্য। যেহেতু আমার দেশ বিশ্বকাপ জয় করেছিল , ভিন দেশের মাটিতে ভারত মাতার পতাকা উড়েছিল আর তার অনুভূতি কেমন ছিল জিজ্ঞেস করলে আমি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এক কথায় বলতে গেলে সেই অনুভূতিটা এইরকম ছিল যেন ভগবানের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল।
প্রশ্নঃ এরপর কেটে গেছে বহু বছর ক্রিকেটের নিয়ম কানুনে প্রচুর পরিবর্তন হয়েছে। তার জন্য কি ক্রিকেট খেলার ধরনে কোনো পরিবর্তন হয়েছে?
উত্তরঃ খেলার নিয়মে বা ধরনে হয়ত পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু নিয়মে পরিবর্তন হলেও খেলার কোনো পরিবর্তন হয়নি। মূল বিষয়টা একই রয়ে গেছে, সেটা হল পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। যেমন ধরুন ড্রাইভ করতে গেছেন, কিন্তু বল দূরে রয়ে গেছে, তখন উঁচু করে ফিল্ডারের ওপর দিয়ে মেরে দিলেন যাতে ক্যাচ না ধরে ফেলে। আর এখন ব্যাটসম্যানরা রিভার্স সুইপ মারে, কিন্তু বিষয়টা সেই একই যেন ফিল্ডার ক্যাচ না ধরে ফেলে। এখন যেমন ফিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে রেসট্রিকশন আছে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে, যা আগে ছিল না। কিন্তু এই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। জীবন যেমন সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনশীল, ক্রিকেটও তাই। নিয়ম পাল্টেছে কিন্তু ক্রিকেটের মূল ধারা একই আছে।
প্রশ্নঃ আপনাদের সময় দলের প্রতি যে নিষ্ঠা বা একশ ভাগই দলকে দিয়ে দেওয়া, তা কি এই প্রজন্মের ক্রিকেটারদের মধ্যে সেভাবে দেখতে পাওয়া যায়?
উত্তরঃ হ্যাঁ এখনও সেই নিষ্ঠা দেখতে পাওয়া যায়। তবে একটা পার্থক্য ছিল। আমদের সময় টেলিভিশন ছিল না, সেভাবে টাকা ছিল না। আমরা প্যাশনের জন্য খেলতাম। জেতার জন্য খেলতাম। আজও ছেলেরা জেতার জন্যই খেলে। ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ জেতে ভারত। এরপর ১৯৮৭ সালে ভারতে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা হয়। তখন ইন্টারন্যাশানাল ক্রিকেট কাউন্সিলে ভারতকে কেউ গুরুত্বই দিতো না। এরপর আইসিসিতে আমাদের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, চেয়ারম্যান হয়েছেন। ৮৩ এর পর ক্রিকেট এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে ১৯৯৩ সালে ইএসপিএন এলো ভারতে আর এখানে খেলার সম্প্রসারন দেখানো শুরু করলো। এরপর টাকা আসতে শুরু করলো। আমাদের সময় তো বিসিসিআইয়ের উপর ২ কোটি টাকা ঋণ হয়ে গেছিল। লতাজি অনুষ্ঠান করেছিলেন যার অর্থ এই ঋণ পরিশোধে কাজে লেগেছিল। আর নিষ্ঠার কথা যদি আসে তো সেখানে কোনো ঘাটতি নেই। তবে হ্যাঁ আগের থেকে সারবছরে ম্যাচের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে, ফলে পারফরমেন্সে হয়ত ওঠা পড়া হচ্ছে। আর তার থেকে মনে হতে পারে নিষ্ঠার ঘাটতি হচ্ছে। আদতে তা মোটেই নয়।
প্রশ্নঃ এখন সারা বছর ধরেই খেলা, ফলে ক্রিকেটারদের শরীর ও মনের উপর চাপ পড়ে। তার প্রভাব কি খেলায় পরে না?
উত্তরঃ অবশ্যই পড়ে, অনেকের ওপরেই পড়ছে। যেমন দেখুন হার্দিক পান্ডিয়া। একটা যন্ত্র টানা চালানোর পর তারও বিশ্রামের দরকার পরে, সেখানে মানুষের শরীর তার বিশ্রামের তো অবশ্যই দরকার। সারা বছর ধরে এভাবে না খেলে একটু কম খেলা দরকার। তাছাড়া, বানিজ্যিক খেলা যেমন আইপিএলের দিকে বেশি না ঝুঁকে ঘরোয়া খেলা, বেশি খেলা দরকার, কারন এই ঘরোয়া খেলা থেকেই আমরা জাতীয় স্তরে পৌঁছেছি।
প্রশ্নঃ ক্রিকেটের ভবিষ্যত কি তাহলে টি-২০?
উত্তরঃ কখনই তা হতে পারে না। টেষ্ট ম্যাচই হচ্ছে আসল খেলা। এতে হাত-জিত, ম্যাচ ড্র, চড়াই উতরাই, সারা দিন ধরে টানা খেলা একভাবে চলছে তারপরেই হয়ত পাশা উল্টে গিয়ে খেলাই পালটে গেল। আর টি-২০ তে হার জিত থাকলেও তাতে মনোরঞ্জনটাই বেশি। ছক্কা বেশি হয়, বাউন্ডারি ছোট করে দেওয়া হয়, খেলা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আমি এখনও মনে করি টেষ্টই হল ক্রিকেটের মেরুদন্ড।
প্রশ্নঃ ‘আইপিএল’-ক্রিকেটের বানিজ্যিকিকরণ। এটা কতটা সমর্থন যোগ্য?
উত্তরঃ টি-২০ তো চলবে। এটা কেউ আটকাতে পারবে না। একদিনে দু’দুটো ম্যাচ হয়। কম সময় লাগে, মনোরঞ্জনে ভরপুর। শুধু দুঃখ একটা বিষয়ে যে, যে ক্রিকেটারদের আমরা ভগবান মানি, সুপারস্টার মানি, শুধু টাকার জন্য আইপিএলের টিম মালিকরা তাদের চাকর মনে করেন। যারা খেলার ‘খ’-ও বোঝে না তাঁরা ড্রেসিং রুমে ক্রিকেটারদের অপমান করেন, দল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন। ক্রিকেটারদের যে সম্মান করা উচিত সেটা এনারা করেন না।
প্রশ্নঃ আপনার চোখে ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা ক্যাপ্টেন কে?
উত্তরঃ বলতে গেলে অনেকেই আছেন যারা ক্যাপ্টেন হিসেবে সফল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত্য আমার চোখে সেরা ক্যাপ্টেন প্রথমে অবশ্যই কপিল দেব। যার হাত ধরে ভারত প্রথম বিশ্বকাপ জেতে। এরপর অবশ্যই বলবো ধোনির কথা। ২০১১ সালে ধোনির হাত ধরে ফের ভারত বিশ্বকাপ জেতে। এছাড়াও ২০০৭ সালে টি-২০ বিশ্বকাপ ধোনির হাত ধরেই ভারতে আসে।
প্রশ্নঃ নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের জন্য কি বার্তা দেবেন?
উত্তরঃ বাচ্চাদের জন্য বলবো পরিশ্রম করো। পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। তবে খেলার সাথে সাথে পড়াশুনাটাও মন দিয়ে করতে হবে। কারন ১৪ জন দলের সদস্য হন, কিন্তু খেলার সুযোগ পান মাত্র ১১ জন। তাই এই প্রজন্মকে বলবো খেলায় কতটা কি করতে পারবে না পারবে জানা নেই, কিন্তু ভাল করে পড়াশুনা করলে অন্তত: একটা ভাল চাকরী করতে পারবে।