রিভিউঃ “শেষ চিঠি” ছায়াছবি নিয়ে কিছু কথা

আমার কথা, দুর্গাপুর, ৭ ফেব্রুয়ারীঃ
সংবাদদাতা: প্রণয় রায়
এক একটা চিঠির অপেক্ষায় আমরা একটা জীবন কাটিয়ে দিই। আসলে আমাদের বুকের ভেতরে ঘরে প্রতীক্ষার বাতায়নে জীবনভর আমরা নিরন্তর অপেক্ষা করি একটা ভালো লাগার আতর মাখা চিঠির। আর সেই শেষ চিঠির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একদিন আমরা চিরদিনের মত ঠিকানাবিহীন হয়ে যাই কিন্তু সেই চিঠি আমাদের আর পাওয়া হয় না। এমনি এক শেষ চিঠির অপেক্ষায় প্রায় দু’ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম সিটি সেন্টারের পার্কল্যান্ড হোটেলের প্রেক্ষাগৃহে।
কি অসাধারণ ব্যঞ্জনময় একটি পূর্ণদৈর্ঘের চলচ্চিত্র “শেষ চিঠি”। এই চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার শো’তে উপস্থিত ছিলেন চিত্র পরিচালক কাজরি মোদক, বুদ্ধিজীবী রনজিত গুহ, সংগীত শিক্ষক বিমল মিত্র সহ বিশিষ্ট অতিথি বৃন্দ ।
শেষ চিঠি এই চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলি যেন আমাদেরই বড়ো পরিচিত মুখ । আমাদের চোখের সামনে অনায়াসে ঘোরাফেরা করেছে। আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে একটা নিটোল গল্পের মধ্যে একটু একটু করে ডুবে গিয়েছি। আসলে এদিনের সন্ধ্যাটা ছিল এক আমন্ত্রণ মূলক পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র দেখার আমন্ত্রণ। ড্রিম সেলার প্রোডাকশন দুর্গাপুরেরই একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ সংস্থা। এই চলচ্চিত্রটির পরিচালক আমাদেরই ঘরের পাশের অত্যন্ত পরিচিত ছেলে শাশ্বত বিশ্বাস। শাশ্বতকে এতদিন আমি চিনতাম এক যোগ প্রাণায়াম বিশেষজ্ঞ হিসেবে। কিন্তু এদিনের সন্ধ্যায় এক অন্য শাশ্বতকে দেখলাম।
ছবির শুরুটা এক সুন্দর আবহ র মধ্যে দিয়ে এক গ্রাম বাংলার মেঠো রাস্তা। স্বামী স্ত্রী ও তাদের ছোট্ট মেয়েটি গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলেছে। ছেলেটির হাতে একটি ব্যাগ। একসময় তারা গ্রামের রাস্তা ছড়িয়ে বড় রাস্তার সামনে এসে দাঁড়ালো। একটা ট্রেকার গাড়ি তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। যাত্রী বহনকারী গাড়ি। সেই লোকটি গাড়িতে উঠে বসলো তার মেয়েকে আদর করল। তার স্ত্রীকে বলল শহরে পৌঁছে সে পৌঁছানোর খবর জানিয়ে চিঠি দেবে । গাড়ি ছেড়ে দিল শুরু হলো এ কাহিনীর আখ্যান। এ কাহিনীর শুরুতে যে ছবি আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠলো তা মুর্শিদাবাদের একদম প্রত্যন্ত গ্রামের ছবি, যে গ্রামে কোন আধুনিকতার ছোঁয়া নেই । টিন, বাঁশ ও খড়ে ছাওয়া সব ঘরবাড়ি, ধান ক্ষেত, খামার, ধানের গোলা, গাছপালা, পুকুর ও গ্রাম্য মানুষদের দৈনন্দিন সুখ দুঃখের কড়চা এ নিয়েই একটা নিস্তরঙ্গ গ্রাম্য জীবন কাহিনী। গ্রামটি এক মুসলমান অধ্যুষিত গ্রাম। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে গ্রামের বড় রাস্তায় শহরে যাবার গাড়ি ও গ্রামের পোস্ট অফিস। গ্রামের মানুষগুলি রুজি রোজগারের জন্য শহরে যায় ও সেখান থেকে এই গ্রাম ছেড়ে বাইরে রোজগার করতে যাওয়া মানুষগুলির খবর নিয়ে এ পোস্ট অফিসে মানিঅর্ডার চিঠি ও চিঠি আসে।
ফতেমা এই চলচ্চিত্রের এক অন্যতম চরিত্র। এক অশিক্ষিত গ্রাম্য মহিলা তার শিশু কন্যা রুকসানা কে নিয়ে সেই গ্রামে থাকে। আর প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকে শহর থেকে তার স্বামীর চিঠি আসবে। আসবে মানিঅর্ডারে পাঠানো টাকা। দিন যায় সময় যায়। না আসে না স্বামীর কোন চিঠি কিংবা টাকা পয়সা। তার পক্ষে সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। তবুও সে অপেক্ষা করে তার স্বামীর চিঠি আসবে।তার স্বপ্ন মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে সে মানুষ করবে। শাকসবজি ইত্যাদি বিক্রি করে কোনরকমে তার সংসার চালায়। গ্রামের লোভী পুরুষদের হাত থেকে থেকে নিজেকে বাঁচায়।একদিন ফতেমা খবর পায় তার স্বামী শহরে আরেকটি সংসার করেছে। সে আর কোনদিন তাদের কাছে ফিরে আসবে না। স্বামীর প্রতি পরম অভিমানেও অপেক্ষা করে তার স্বামী, টাকা পাঠাবে, চিঠি পাঠাবে ও তাদের খবর নেবে। কিন্তু তার স্বামী আর ফিরে আসে না।
তার কষ্টের সংসারে দুঃখের ভাত খেয়ে রুকসানা বড় হয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবে ও তার মাকে ভালো রাখবে। তার আব্বুর উপর তার খুব অভিমান।
সুন্দর ঝকঝকে ফটোগ্রাফি ও নেপথ্য সংগীত চলচ্চিত্রটিকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়। দর্শকদের এক মুহূর্ত ছবি থেকে তাদের মনকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে না। গ্রাম জীবনের অনবদ্য ছোট ছোট দৃশ্য মনটাকে কেমন যেন আনমনা করে দেয়। সত্যজিৎ রায় এর বিভিন্ন ছবিতে যেমন খুব ছোট ছোট দৃশ্যর অবতারনা ও মনমুগ্ধকর ছবির প্রেক্ষাপট আমাদের মুগ্ধ করে দেয় ঠিক তেমনি ই ছবির পরিচালক এমন সব সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করেন তাতে ছবিটি আবিষ্ট হয়ে দেখতে হয়। যখন পথের পাঁচালীর শেষের দিকে যখন অপু তার মা বাবার সঙ্গে কাশী যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ঠিক তখনই তাদের বাড়ির কুলঙ্গীতে রাখা একটি বাক্সে দুর্গার চুরি করে রাখা পুতির মালা সে খুঁজে পেয়ে বাড়ির বাইরে এসে ছুঁড়ে দেয় একটি পুকুরে এবং পুকুরে একটা জলের বুদবুদ কেটে মালাটি ডুবে যায়। এই ছবিতেও ঠিক তেমনি এক দৃশ্য যখন ফতেমাকে করাত কলের মালিক কু প্রস্তাব দিয়ে একটা আপেল খেতে দেয় এবং ফতেমা সেখান থেকে পালিয়ে এসে চরম ঘৃণায় আপেলটি একটি পুকুরে ছুড়ে দেয় এবং জলে বুদবুদ কেটে আপেলটি ডুবে যায় তখন যে অসাধারণ দৃশ্যের অবতারণা হয় তা মনে রাখার মত। এরকম অনেকগুলি ছোট ছোট দৃশ্য আছে যে ছবিটিকে একটি নান্দনিক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়।
আবার গল্পে আসি। রুকসানা বড় হয় তার মায়ের কষ্টের সংসারের আয়ে। তার বান্ধবীর সঙ্গে গ্রামে স্কুলে পড়তে যায়। তার মনে স্বপ্ন বড় হয়ে মায়ের সব দুঃখ দূর করবে। কিন্তু সেলিম বলে একটি ছেলের সে প্রেমে পড়ে। ছেলেটি তার ধর্ম লুকিয়ে রুকসানার সঙ্গে প্রেম করে। তাদের কথা গ্রামে জানাজানি হয়। বিধর্মী ছেলের সঙ্গে এ সম্পর্ক গ্রামের মানুষ মেনে নিতে পারে না। তারা ফতেমার বাড়ি এসে ফতেমাকে সাবধান করে। রুকসানা বাড়ি ফিরে এসে দেখে তার মাকে সবাই অপমান করছে। মেয়েকে ফিরতে দেখে ফতেমা প্রচন্ড ক্রোধে তাকে নিয়ে ঘরে বন্দী করে রাখে।বলে তোকে আর স্কুলে পড়তে হবে না। গ্রামের মুরুব্বীরা ঠিক করে পরদিন কোন এক দোজবরের সঙ্গে তার বিয়ে দেবে। পরদিন সকালে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে রুকসানা সেই ছেলেটির সঙ্গে দেখা করে। বলে তুমি হিন্দু এ কথা আমাকে আগে জানাওনি কেন। ছেলেটি বলে জানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম তুমি যদি আমাকে না মেনে নাও তাই তোমাকে কিছু জানাইনি। আমার ভুল হয়ে গেছে তুমি যদি আমাকে না মেনে নিতে পারো তুমি ফিরে যাও। রুকসানা তাকে বলে না তুমি যাই হও আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। তুমি চলে গেলে আমি আত্মহত্যা করব । এখানেই রুকসানা আর ছেলেটির ঘটনার ইতি টানে পরিচালক। আমাদের সবার মনে একটা প্রশ্ন জাগে এরপর কি হলো। দিন যায় সময় যায় ফতেমার বয়স বাড়তে থাকে একদিন সে বৃদ্ধা হয়। কিন্তু অপেক্ষা করে একদিন তার মেয়ে ফিরে আসবে কিংবা তাকে অন্তত একটি চিঠি দিয়ে জানাবে সে কেমন আছে। তাদের পাশের পাড়া সুখময় বাবু বলে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়ে সে তার জীবনের সুখ দুঃখের গল্প করে। বলে তোর স্বামী মেয়ের কথা আর বলে সব অপেক্ষা করছে তাদের কাছ থেকে একটা চিঠি পাবে যেখানে সে সব খবর পাবে। বৃদ্ধ সুখময়বাবু এই বৃদ্ধা মহিলার জীবন কাহিনী শুনে বড় কষ্ট পান। তার কাছে বিক্রি করতে নিয়ে আসা সবজি কেনা নিয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হয়। তার স্ত্রীর বিশ্বাস মনগড়া গল্প বলে ফতেমা তার স্বামীকে বেশি দামে সবজি বিক্রি করে।
আরো দিন যায় ফতেমা অস্থির হয়ে পড়ে তার মেয়ের একটি চিঠির জন্য। সুখময়বাবু বুঝেন এই অসক্ত দরিদ্র বৃদ্ধার যন্ত্রণার কথা। কারণ তার মেয়েও দূরে থাকে সময় মত তার চিঠি ও খবর না পেলেও তার খুব দুশ্চিন্তা হয়। একদিন সুখময় বাবুর স্ত্রীর সঙ্গে ওই বৃদ্ধাকে নিয়ে খুব কথা কাটাকাটি হয়। সুখময় বাবু বলেন ওই বৃদ্ধা তার কাছে আসে যদি তার মেয়ের কোন চিঠির খবর সুকুমার বাবু দিতে পারেন। সুখময়বাবুর স্ত্রী রেগে গিয়ে তাকে বলেন তোমার নিজের মেয়ের চিঠিই তো অনেকদিন আসছে না সেখানে তুমি অন্যের মেয়ের খবর নিয়ে এত কেন বাড়াবাড়ি করছ। যাও গ্রামের ডাকঘরে গিয়ে দেখে এসো তোমার মেয়ের কোন চিঠি এসেছে কিনা। সুখময় বাবু বেরিয়ে পড়েন গ্রামের ডাকঘরে। সেখানে পোস্টমাস্টার তাকে সাদরে বসিয়ে বলেন ডাক পিয়ন ছুটিতে তাই কয়েকদিন ডাক বিলি করা হয়নি। তিনি অফিসের একজন কর্মীকে ডাকেন ও বলেন সুখময় বাবুর কোন চিঠি এসেছে কিনা দেখতে । সেই কর্মী চিঠির তাড়া থেকে একটা চিঠি বের করে সুকুমার বাবু কে দেয় । সুখময়বাবু মেয়ের চিঠি নিয়ে ফিরে আসছিলেন তখন তার হঠাৎ মনে হল একবার প্রতিমা বিবির কোন চিঠি আছে কিনা পোস্টমাস্টার কে জিজ্ঞেস করে দেখেন। ফতেমা বিবির গ্রামের নাম বলে সেই গ্রামের যে ডাক পিয়ন ফতেমা বিবির গ্রামে চিঠি নিয়ে যায় তাকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলে কদিন আগে ফতেমা বিবির বাড়ি একটি চিঠি দিয়ে এসেছে।
সুখময় বাবু বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে রাতে দোতলার ঘরে ঘুমিয়ে আছেন হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টিতে তার ঘুম ভেঙে গেল। তার মনে হল ফতেমা বিবি চিৎকার করে তাকে ডাকছে। তিনি ঘরের জানালা খুলে দেখতে পেলেন প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একটা একটা মান কচু পাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টি আটকে ফতেমা বিবি তাকে কাঁদতে কাঁদতে বলছেন বাবু গো আমার তো আর কোন চিঠি দেখা হলনা। তিনি নিচে নেমে দেখলেন কেউ নেই।
পরদিন সকালে তিনি ফতেমা বিবির গ্রামে যান যান। সেখানে গিয়ে ফতেমা বিবি বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করতেই পথ চলতি একজন গ্রামের লোক বলল ফতেমা বিবি সাতদিন আগে কবরে গেছে। তিনি চমকে উঠে ফতেমা বিবির বাড়ির বেড়া তে একটা পোস্ট কার্ড আটকানো দেখেন তাতে ফতেমা বিবির নাম ও ঠিকানা লেখা। গ্রামের মানুষকে জিজ্ঞাসা করে তিনি গ্রামের বাইরে ফতেমা বিবির কবরের সামনে যান সেখানে গিয়ে ফতেমা বিবির এক জীবন অপেক্ষা করা শেষ চিঠিটা তার কবরের উপরে রেখে দেন আর সেখানে রুখসানা লাগানো চাপা গাছ থেকে নিয়ে আশা ফুল দিয়ে কবরের উপর ছড়িয়ে দেন।
চলচ্চিত্রটির গল্পটি পুরোটাই বললাম এজন্য যে গল্পটি মনে দাগ কাটার মত একটি গল্প। অপেক্ষার বাতায়নে একটি অশিক্ষিত মহিলা একটা জীবন কাটিয়ে দিল তার স্বামী ও কন্যার একটা চিঠির জন্য। শেষ সে চিঠি এলো কিন্তু তার আর সেই চিঠি দেখা হলো না।
পরিচালক শাশ্বত বিশ্বাস তার নিজেরই কাহিনীটি নিয়ে এক অসাধারণ চলচ্চিত্র আমাদের উপহার দিলেন। এই চলচ্চিত্রের চরিত্ররা সবাই প্রায় দুর্গাপুরের বিভিন্ন নাট্য দলের অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা। অথচ সবার কি অসাধারণ অভিনয়। রুকসানার ছেলেবেলার চরিত্রে রূপাঞ্জনা দত্ত নামে যে শিশু কন্যাটি কন্যাটি অভিনয় করল সম্ভবত প্রথম অভিনয়ের অভিনয় কিছুটা আড়ষ্ট হলেও শিশুটি কিছু কিছু অসাধারণ দৃশ্য আমাদের উপহার দিয়েছে । ছোট রুকসানার চরিত্রের অভিনয়ের ঘাটতি পুষিয়ে দিল বড় রুকসানা শ্রেয়সী চ্যাটার্জির অভিনয়। কি অসাধারণ অভিনয় এবং মুর্শিদাবাদের গ্রাম্য ভাষা এইভাবে রপ্ত করে এত সাবলীল অভিনয় করলো মেয়েটি যে আমাদের শুধু মুগ্ধ নয় অবাক করে দিল। ফতেমা চরিত্রের চরিত্রের দুটি রূপ। যৌবনের প্রথম ফতেমার অভিনয় করল সোমিয়া বিশ্বাস। অসাধারণ চরিত্রায়ন। তেমনি অভিনয়, অভিব্যক্তি, ব্যঞ্জনা সবকিছু ছিল চরিত্রটির মধ্যে। আর বৃদ্ধা সেলিনার চরিত্রে অভিনয় করলেন সুরভি বিশ্বাস। দুর্গাপুরের খুব পরিচিত মুখ কিন্তু কখনো সুরভি বিশ্বাসকে মনে হয়নি পরিচিতা সুরভি বিশ্বাস বলে মনে হচ্ছিল এক বৃদ্ধা গ্রাম্য অশিক্ষিত মুসলিম মহিলা ফতিমাকে দেখছি। তবে সুরভি বিশ্বাসের মুর্শিদাবাদের টানে আমি কথাটা হামি উচ্চারণ করায় একটু কানে বাজছিল। আমি অবশ্য বলতে পারব না ওখানকার গ্রাম্য উচ্চারণে আমি হামি বলা হয় কি না।
সুখময় বাবুর চরিত্রে সব্যসাচী বিশ্বাস আমাদের উপরি পাওনা। বিশেষ করে ছবির শেষে যখন ফতিমার কবরে তিনি রুকসানার শেষ চিঠিটা রেখে তাতে চাঁপা ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছেন আর তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে তখন আমাদের চোখ ও অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে।
এবার একটু অন্য কথায় আসি। এই চলচ্চিত্রটি অনায়াসে আন্তর্জাতিক কোন প্রতিযোগিতায় পাঠানো যেতেই পারে। তবে চলচ্চিত্রটি সম্পাদনা করে আরো ছোট করা যেতে পারত। বিশেষ করে বৃদ্ধা ফতিমার অভিনয়ের দৃশ্যের পরিসর আরো আরো কিছুটা সংক্ষিপ্ত চলচ্চিত্রটি আরো নিটোল হতো। জানিনা প্রেক্ষাগৃহে শব্দ যন্ত্রের গোলমাল কিনা তবে মাঝে মাঝে কিছু চরিত্রের কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না এ ব্যাপারে পরিচালক একটু দৃষ্টি দিতে পারেন। ক্যামেরার কাজ অসাধারণ। বিভিন্ন ছোট ছোট দৃশ্যের যেভাবে দৃশ্যায়ন হলো তা মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। গ্রামের পথে ছাগলের পাল ফিরে যাচ্ছে তার পিছনে রুকসানা হাঁটছে কিম্বা যখন সেই ছেলেটির কাছে আত্মসমর্পণ করে রুকসানা বলছে আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না তখন আকাশে এক পাল মুক্ত বিহঙ্গ উড়ে যাচ্ছে অসাধারণ এক দৃশ্যায়ন। অনেকগুলি চরিত্রই খুব ছোট কিন্তু প্রত্যেকের অভিনয়ই মনে রাখার মত। বিশেষ করে সাইকেলে চিঠি নিয়ে যাওয়া সেই ডাক পিয়ন।বা গ্রামের সেই দুজন মুরব্বী বা নীরব দর্শক অথচ প্রতিবাদী চরিত্রগুলো। সুন্দর রূপসজ্জ্বা। আর একজনের কথা না লিখলেই নয় তিনি বিধুকান্ত পাল। শ্রীপাল চলচ্চিত্রটির ক্যামেরা আলো ও সম্পাদনার কাজ করেছেন।
লেখাটা বেশ বড় হয়ে গেল। আসলে শহর কলকাতার বাইরে এক মফস্বলের শহরেও যে এত সুন্দর একটা নান্দনিক পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র তৈরি হতে পারে তা শেষ চিঠি চলচ্চিত্রটি না দেখলে বুঝতে পারতাম না। ধন্যবাদ শাশ্বত ধন্যবাদ টিম শেষ চিঠি।