সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত দুর্গাপুরের ‘দেবস্মিতা’র কাছে ‘কবিতা’ই সংগ্রামের হাতিয়ার
আমার কথা, পশ্চিম বর্ধমান(দুর্গাপুর), ৮মার্চঃ
আজ আন্তিওর্জাতিক নারী দিবস, আর এই দিনে সারা বিশ্ব জুড়ে নারীদের নানাভাবে সম্মান জ্ঞাপন করা হয়। কিন্তু পাশাপাশি এই প্রশ্নও ওঠে সমাজে নারীর যা ভূমিকা একটি নির্দিষ্ট দিন কি নারীর জন্য বলা যায়? হয়ত যায় না। এই দিনে অনেক নামজাদা নারীদের সফলতা, কিংবা তাদের সংগ্রামের কাহিনী নিয়ে আলোচনাও শুনতে পাওয়া যায় বিশেষ করে এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে। কিন্তু আমাদের সমাজের আনাচে কানাচে এমন অনেক নারী রয়েছেন যাদের সংগ্রামের কাহিনী লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যায়। কালের আবর্তনে হয়ত তাঁরা হারিয়েও যেতেন যদি না তাদের কিছু করে দেখানোর, বা পিছিয়ে না থাকার অদম্য প্রচেষ্টা না থাকতো। আজ নারী দিবসে এরকমই একজন নারীর সংগ্রামের কথা আমরা শুনব।
দুর্গাপুরের বিধাননগরের বাসিন্দা দেবস্মিতা নাথ। যার বাস হল ছন্দ আর কবিতার পৃথিবীতে। বছর কুড়ির দেবস্মিতার বাবা দেবাশিষ নাথ পেশায় একজন ব্যাংক কর্মী ও মা সুমিতা নাথ একজন গৃহবধূ। ২০০১ সালে সুমিতাদেবীর কোল আলো করে জন্ম নিলো তাদের স্বপ্নের রাজকন্যা দেবস্মিতা। আর পাঁচটা শিশুর মতোই দেবস্মিতা বেড়ে উঠছিল বাবা ও মায়ের আদরে। কিন্তু কোথাও ছন্দপতন ঘটল যখন মাস ছয়েক পেরোনোর পরেই স্বাভাবিক বাড় দেবস্মিতার মধ্যে দেখতে পাওয়া গেল না। দুরু দুরু বুকে একজন শিশু চিকিৎসকের কাছে দেবস্মিতাকে নিয়ে যাওয়া হয়। খুব একটা আশার বানী শোনাতে পারলেন না সেই চিকিৎসক। ধীরগতিতে বড় হতে থাকা দেবস্মিতা তখন থেকে শারীরিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়তে শুরু করল আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশুদের থেকে। ফলে বড় সড় মানসিক ধাক্কা খেলেও ভেঙ্গে পড়লেন না নাথ দম্পতি। তখন থেকে দাঁতে দাঁত চেপে শুরু হল দেবস্মিতাকে নিয়ে লড়াই। একদিকে শুরু হল দেবস্মিতার চিকিৎসা আর অন্যদিকে দেবস্মিতাকে ভর্তি করানো হল স্কুলে যাতে স্কুলের পরিবেশের মধ্যে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসতে পারে দেবস্মিতা। যদিও অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল ওই এক রত্তি শিশুটিকে। কিন্তু দেবস্মিতার মায়ের স্নেহ আর মমতায় সেটুকুও কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল দেবস্মিতা। দেবস্মিতার বয়স যখন সাড়ে তিন বছর বয়স তখন সে প্রথম ‘মা’ বলে। এরই মাঝে স্কুলে নানা মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার ও অসহযোগিতার মধ্যে দিয়ে চলতে হচ্ছিল দেবস্মিতাকে। কিন্তু তাতেও দমানো যায়নি ওই শিশুকন্যাকে। তারই মাঝে চলতে থাকে দেবস্মিতার শারীরিক কার্যকলাপ স্বাভাবিক করার জন্য নানা প্রক্রিয়ায় অবলম্বন করা হচ্ছিল। এবার শুরু হল দেবস্মিতার কবিতার জগতে আনাগোনা।
সুমিতাদেবীর কাছেই প্রথম দেবস্মিতার কবিতার প্রশিক্ষণ শুরু। তারপর বিশিষ্ট আবৃত্তিকার শম্পা রায়চৌধুরীর কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া। এরই মাঝে ২০০৬ সালে প্রথম আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দেবস্মিতা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। জীবন সংগ্রামের সফলতার জগতে প্রথম ধাপে পা রাখল সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত দেবস্মিতা। কবিতার সাথে সাথে শারীরিক আর মানসিক বিকাশের জন্য দেবস্মিতার অঙ্কন, সাঁতার প্রশিক্ষন ও ফিজিওথেরাপি চলতে থাকে। এরপর দেবস্মিতা আর থেমে থাকেনি। জেলা ও রাজ্যস্তরের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া শুরু, সাথে পুরষ্কার জেতার পালা চলতে থাকে। শুরু হয় নিজের পরিচিত তৈরীর সংগ্রাম। একটু একটু করে দেবস্মিতার সংগ্রামের কাহিনী জানতে শুরু করেন অনেকেই। দেবস্মিতার যখন ১৩ বছর বয়স তখন নিজের যোগ্যতায় সে বিখ্যাৎ আবৃত্তিকার ব্রততী বন্দোপাধ্যায়ের নজরে আসে সাথে তাঁর “কাব্যায়ন” এ প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পায়। সেই সময় আবৃত্তি প্রশিক্ষনের সাথে সাথে দুর্গাপুর সহ শহরের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকা দেবস্মিতার ঝুলিতে একের পর এক সম্মান আসতে শুরু করে। ২০২০ সালে দেবস্মিতা কনিষ্ঠতম বাচিক শিল্পী হিসেবে পঞ্চম বর্ষ বঙ্গ প্রমিলা কৃতিরত্ন পুরষ্কারে ভূষিত হয়।
বর্তমানে দেবস্মিতা কলেজে পাঠরতা। পাশাপাশি কবিতাকে পাথেয় করেই চলছে তাঁর পথচলা। এতদিনের তাঁর অভিজ্ঞতায় ভর করে সে বর্তমানে কিছু শিশুকে আবৃত্তির প্রশিক্ষণ দেওয়াও শুরু করেছে। নিজের পায়ে পুরোপুরো ভর দিয়ে চলতে না পারলেও দেবস্মিতার ‘মা’ই যে তাঁর অনেক বড় চলার অবলম্বন। যদিও দেবস্মিতার জীবনের এই পথ খুব একটা সুগম ছিল না। কিন্তু পিছিয়ে না পড়ে কিছু করে দেখানোর জেদ দেবস্মিতাকে নিশ্চয়ই সফলতার শিখরে একদিন পৌঁছে দেবে। আজ আন্তর্জাতিক নারীদিবসে “আমার কথা” পক্ষ থেকে দেবস্মিতাকে জানাই অনেক অনেক শুভেচ্ছা। সাথে এই আশাও রইল যে আজকের দেবস্মিতা ভবিষ্যতে এরকম অনেক দেবস্মিতার কাছে যেন জ্ব্লন্ত উদাহরন হয়ে ওঠে। অনুপ্রেরণা কাজ করে।