ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা……
আমার কথা, প্রণয় রায়, দুর্গাপুর, ৩ নভেম্বরঃ
আজ ভাইফোঁটা। সকাল থেকেই ওর ছোট্ট দাদা বনুর পিছনে পিছনে ঘুরছে আর বলছে বনু মাকে বল না তাড়াতাড়ি লুচি ভাজতে। আমার যে বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। ছোট্ট বনু বলে একদিন তো দাদা। তোর স্নান হয়েছে? আমি কিন্তু স্নান করে নিয়েছি। তখনই মা ডেকে বলেন তোমরা দুজনেই স্নান করেছো তো? আমার কিন্তু সব রেডি। ছোট্ট দাদা ছোটে স্নান করতে।
আমি ওদের দেখছিলাম আর ভাবছিলাম আমার ছেলেবেলার কথা। আমরা চার ভাইবোন। তখন বালুরঘাট থাকতাম। আমার ছেলের মত আমি ও আমার বোনেদের বলতাম মায়ের আর কত দেরী হবে রে? আমাদের যে বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে? কি আনন্দ ছিল ছেলেবেলার ভাইফোঁটার দিনগুলিতে। কত বছর পরিয়ে গেল। আজ আমাদের বোনেরা কতদূরে ওদের সংসারে।ছোট বোন আজই চলভাসে ফোন করেছিল দাদা ভাল থাকিস। এবার ও দেওয়ালে তোর নামে ফোঁটা দিলাম। তারপর যা বলছিলাম ছোট্ট দাদা স্নান করে এসেই দেখে মা কি সুন্দর একটা আাসন পেতে তার সামনে কত খাবার সাজিয়ে রেখেছে। আর বনু একটা সুন্দর জামা পরে একটা থালায় দুব্বো চন্দন সাজিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। ও বসতেই বনু ওর কপালে ফোঁটা দিয়ে বলল ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা……
বনু ফোঁটা দেবার পরই ছোট্ট দাদা একটা সুন্দর বার্বি ডল বনুর হাতে দেয়। বনু খুব খুশী হয়ে বলে ওমা তুই কখন কিনলি ওটা? দাদা বলে বাবা কিনে দিয়েছে আমাকে। এরপর বলে বনু আমাকে তুই কিছু দিবি না? বনু তখন মজা করে বলে বাবা তো তোকে দেবার জন্য আমাকে কিছু দেয় নি। ছোট্ট দাদার চোখ দুটে ছলছল করছে দেখে বনু বলে আর অভিমান করতে হবে না। বাবা তোর জন্য ক্রিকেট ব্যাট টা এনেছে। প্রতি বছর ওরা এভাবে ভাইফোঁটা দিতে দিতে একদিন বড় হল। মেয়ে এখন দূর বিদেশে নিজের সংসারে। আর ওর ছোট্ট দাদাটি ছবি হয়ে ওর ঘরের দেওয়ালে ছবি হয়ে আছে। প্রতি বছর ওর বনু ওর ছবিতে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে বলে যেখানেই থাকিস ভাল থাকিস দাদা ।
আর আমার বোনেরা বহুদূরে থাকলে কি হবে। গোটা শহর জুড়ে ছড়িয়ে আমার অসংখ্য বোনের মধ্যে অনেকেই প্রতিবছর আমাকে ভাইফোঁটায় ফোঁটা দেয়। আজ সকালেই আমার প্রাণায়াম ক্লাসের কয়েকজন বোন ও দিদি আমাকে ও আরও কয়েকজনকে কত যত্ন করে ভাইফোঁটা দিল।
জীবনের এই সায়াহ্নকালে বোনেদের এই আন্তরিক ভালবাসা মাখা ফোঁটা আমাকে বাঁচবার শক্তি দেয়।
মনে পড়ে আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলের ভাইফোঁটার দিনে তার বনুকে বলা ব্ড্ড ক্ষিধে পেয়েছেরে বনু। কখন ফোঁটা দিবি।
আরও মনে পড়ে আমার প্রাণায়াম ক্লাবের হারিয়ে যাওয়া সেই দিদিদের কথা যারা কত যত্ন করে প্রতিবছর আমাকে ভাইফোঁটা দিতেন।।
আজ নন কোম্পানি বিক্রিয়েশন ক্লাবের প্রভাতী প্রাণায়াম ও লাফিং ক্লাবের বোনেরা ক্লাব প্রাঙ্গণে এক প্রাণবন্ত ভাই ফোঁটার আয়োজন করে। ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা। বোনেরা এই কথাগুলো বলে বয়স্ক ভাই ও দাদাদের কপালে চন্দনের তিলক পরিয়ে দেয়। মাথায় দেয় ধান দুর্বা সে এক স্মৃতিমেদুর আবেগঘন ভাইফোঁটা। নিজের বোনেরা নাই বা থাকলো কাছে কিন্তু এটাই বা কি কম পাওনা। সবচেয়ে বড় কথা আজ নন্ কোম্পানী রিক্রিয়েশন ক্লাবে বোন ফোঁটার আয়োজন করা হয়। বয়স্ক ভাইয়েরা বোনেদের কপালে চন্দন তিলকপরিয়ে বলে আনরা বেনেদের সুরক্ষার ভার নিলাম।
ভাইফোঁটা হল ভাই বোনের সম্পর্কের বন্ধনে প্রজ্বলিত নিবিড় ভালোবাসার অনির্বাণ শিখা। মৃত্যু দেবতা যম তার বোন যমুনার বাড়ি ভ্রাতৃ দ্বিতীয়ার নির্দিষ্ট দিনে গেলে যমুনা তার কপালে তিলক পরিয়ে মালা পরায়। মিষ্টি খাওয়ায়। যমের প্রত্যুত্তরে বোনকে আশীর্বাদ করে বিশেষ উপহার প্রদান করে। ঐদিনই যমরাজ ঘোষণা করেন এ দিনে যে ভাই বোনের হাত থেকে কপালে তিলক বা ফোঁটা গ্রহণ করবে সে সুখী হবে। কৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করে ফিরে আসার পর তার বোন সুভদ্রা কৃষ্ণকে ভাই ফোঁটা দিয়ে তার মঙ্গল কামনা করেছিলেন।
অনুমান করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৭ সাল থেকে এই প্রথা চালু হয় একাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মহাবীর জৈনর নির্বাণ লাভের পর তার সঙ্গী নন্দীবর্ধন খুব ভেঙ্গে পড়লে তার বোন সুদর্শনা রাজাকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ায় রাজের কপালে তিলক এঁকে বলেন মঙ্গলের পথে এগিয়ে চলুন । অনেকে বলেন সেই থেকে ভ্রাতৃ দ্বিতীয়ার সূচনা হয়। লোকতত্ববিদ ও ঐতিহাসিক শৈলেন্দ্র হালদারের মতে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক পট পরিবর্তন কৃষির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বোনেরা ভাইদের নিরাপত্তা ও সাফল্যের জন্য এই উৎসব পালন করেন।
আজ থেকে ৪০০ বছরের ও আগে মোগল সম্রাট আকবর হিন্দু প্রজাদের খুশি করতে দিওয়ালির প্রচলন করেন ও হিন্দু রাজপুত রমণীরা আকবরকে তিলক পরিয়ে ভ্রাতৃত্বে বরণ করেন।
সনাতন ধর্মে মানুষের পাঁচটি আঙ্গুল কে পঞ্চভূতের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এগুলি হলো ক্ষিতি, অপ,তেজ,মরুত ও ব্যোম। এখানে ব্যোম অর্থাৎ হাতের কড়ে আঙ্গুল হলো মহাশূন্যের প্রতীক। শাস্ত্র মতে ভাই বোনের ভালোবাসা মহাশূন্যের ন্যায় অসীম তাই বোনেরা ভাইদের বাম হাতের কড়ে আঙ্গুল দিয়ে ভাইফোঁটা দেয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন নামে ভাই ফোঁটা পালন করা হয়। কোথাও তার নাম ভাইদুজ, কোথাও ভাইটিকা, ভাইবীজ আবার নেপালে তার নাম ভাই লগন।
১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথের ৮৪ বছরের দিদি বর্ণ কুমারী দেবী আশি বছরের অসুস্থ ভাই রবীন্দ্রনাথকে ভাইফোঁটা দিয়েছিলেন।