বাঙালী তুমি কি তর্ক ভুলিয়াছো?
আমার কথা, বিশেষ প্রতিবেদন, ২৯ জুনঃ
লেখকঃ কুন্তল দাস (ইসিএল কর্মী)
তর্ক বা বিতর্ক।বাদানুবাদ, বিচার, যুক্তি, বচসা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তর্কবিদ যুক্তিবিদের নাম সক্রেটিস। ছাপাখানা আবিষ্কারের বহু আগে তিনি তার প্রগতিশীল চিন্তা তর্কের বা বিতর্কের মধ্যেই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। গত শতকের শেষ দুই দশকেও আমরা দেখেছিএই বাংলার পাড়ায় পাড়ায় কত আড্ডার আসর বসতো। বিভিন্ন বয়সীদের বিভিন্ন আড্ডার আসর। সে সময় বাঙালি কোনরকম তর্কে পিছিয়ে ছিলনা। সেসব আড্ডার আসর মানেই অবধারিত ছিল তর্ক। কত না বিষয়ে ছিল বাঙালির তর্কের- রবীন্দ্র-নজরুল,হেমন্ত-মান্না,উত্তম-সৌমিত্র,পেলে- মারাদোনা,মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল,পিকে-অমল দত্ত,ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা,বামপন্থা-দক্ষিণপন্থী। তবে বেশিরভাগ হতো সমসাময়িক কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে।অর্থাৎ-‘কারেন্ট অ্যাফেয়ার’। আরো কত কত বিষয়ে ছিল বাঙালি তর্কের। আমাদের বাংলায় যেমন অনেক সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত হয় বৃষ্টি হয় ঠিক তেমনি অতি শান্ত পরিবেশেও হঠাৎ হঠাৎ শুরু হতো গুরুগম্ভীর উচ্চস্বরে তর্ক। আস্তে আস্তে বোঝা যেত দুটি দলে ভাগ হচ্ছে আসর। এরা যুক্তি দেয় তো ওরা খন্ডন করে ওরা যুক্তি দিলে এরা খন্ডন করে। কোন তর্কই কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলত না। কদাচিৎ রাগ বা অভিমান হলে তার পরমায়ু বড়জোর দু-এক দিন। জীবনে এমন কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে যা বেশ চমকপ্রদ। কিছু কিছু তর্ক হতো দিনের পর দিন। সকালে শুরু হলে চলে দুপুর পর্যন্ত।আবার বিকেলে শুরু হয়ে চলে রাত্রি পর্যন্ত। সেসব তর্ক বা বিতর্কে শ্রোতার সংখ্যাও যে খুবই অপ্রতুল ছিল তা বলা যায়না।এমন হয়েছে কখনো বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়েছে। হয়তো রাস্তা দিয়ে হনহন করে চলেছেন কোন শিক্ষক বা অধ্যাপক।জোর করে এনে জড়ানো হয়েছে তর্কে। তিনি সমাধানে আসতে পেরেছেন কি পারেন নি সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু অব্যাহতি সহজে পাননি একথা সহজে অনুমেয়। কিছু জন ছিল তর্কের অলরাউন্ডার। তারা সব বিষয়েই পারদর্শী।কিছু জন ছিলেন বিশেষজ্ঞ তর্কবিদ। কেউ রাজনীতি কেউ খেলাধুলা কেউ সিনেমা কেউ গান। তারা নিজেদের পছন্দসই বিষয় না হলে সাধারণত মাঠে নামতেন না। উদাসীন ভাবে থাকলেও তাঁদের কান থাকতো খারা। একবার মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ সল্টলেকে। সৌভাগ্যক্রমে আমি গ্যালারিতে উপস্থিত।মোহনবাগানের ফাস্ট টিম কেমন হবে?প্রশান্ত ব্যানার্জিকে ম্যান মার্কিং করা হবে না জোনাল মার্কিং?কার পরিবর্তে কখন কাকে নামানো হবে? আজ কাকে খেলান উচিত কাকে বসানো উচিত এইসব নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে যখন আমার আগে বসা দুই সিনিয়র মোহনবাগান সমর্থক তর্ক করে যাচ্ছেন – আর আমি অবাক হচ্ছি তাদের ফুটবলের ওপর অগাধ জ্ঞান দেখে। আরো বাকি ছিল – পরের দিন সর্বোচ্চ প্রচারিত বাংলা দৈনিকে শ্রদ্ধেয় চুনী গোস্বামীর কলমে তাদের মতামত মিলে যাওয়ায়। এইসব ব্যক্তি যে পাড়ার আড্ডার আসরে ফুটবল বিষয়ে তর্কের তুফান তুলতেন এ বিষয়ে নিঃসন্দেহে । একবার লোকাল ট্রেনে ফিরছি – দুই ব্যক্তির মধ্যে শুরু হয়েছে তর্ক। তারা নিত্যযাত্রী এবং পরস্পরের পরিচিত। বিষয় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা নিয়ে – শাসক ও বিরোধীদলের অবস্থান। তর্ক জমে উঠেছে। কামরার অন্য যাত্রীরা কেউ পেপার পড়তে পড়তে কেউ জানলার চলমান দৃশ্য দেখতে দেখতে কান পেতে আছি। তর্কে যিনি একটু পিছিয়ে পড়েছেন তাঁর গন্তব্য চলে এসেছে। না। তিনি কিন্তু নামলেন না। যতক্ষণ না একটা সম্মানজনক অবস্থাতে ফিরে এলেন। তারপর নেমে ফিরতি টেনে ফিরলেন।সেই তর্কবিদকে মনে মনে কুর্নিশ নাকরে পারিনি। এনারাই তো ছিলেন হয়তো বাঙালির তর্কের শেষ প্রজাতি। এ প্রজন্মের বাংলার ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি স্মার্ট হয়েছে। হাতে স্মার্টফোন। কিন্তু আমরা তাদের হাতে তুলে দিতে পারিনি পাড়ার আড্ডা, ক্লাবের আড্ডা। তর্কের আসর। তর্ক বিতর্ক না করলে মেদহীন জ্ঞানে ঋদ্ধ হয়ে ওঠা হয় কি?বাড়ে না পরস্পরের জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা ও সৌন্দর্যবোধ। এখনতো চোখে পড়ে না বাঙালিকে মাঠে ময়দানে পাড়ায় ক্লাবে তর্ক করতে।
বাঙালী,তুমি কি তর্ক করতে ভুলিয়াছো?