করোনা গ্রাস করেছে তাঁতিপাড়ার মাকুরের শব্দকে, পরিবার নিয়ে পুজোর মরসুমেও অনিশ্চয়তায় লাউদোহার তাঁতিরা
আমার কথা, পশ্চিম বর্ধমান(লাউদোহা), ২৭সেপ্টেম্বরঃ
বন্ধ কাঁচা মালের জোগান, মেলেনি উৎপাদনের বরাত, জোটেনি সারকারি ভাতাও। এ রকম অবস্থায় দিন কাটছে দুর্গাপুর ফরিদপুর ব্লকের গৌরবাজার এলাকার তাঁত শিল্পীদের। আর্থিক অনিশ্চয়তার কারনে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছে নতুন প্রজন্ম।
কাশ ফুল, ঢাকের বোল, মহালয়ার মন্ত্র উচ্চারণ এর মধ্যে দিয়ে হয়ে গেছে মায়ের বোধন। মাঝে কয়েকটা দিনের অপেক্ষা, তারপরেই আপামর বাঙালি মাতবে মা দুর্গার আরাধনায়। তবু এই উৎসব আবহে ও মন ভালো নেই গৌরবাজার এলাকার তাঁত শিল্পীদের। কাঁচামালের অভাব আর মহাজনেদের কাছ থেকে বরাত না আসায় আশঙ্কায় দিন কাটছে তাঁত শিল্পী পরিবারগুলির।
করোনা অতিমারির কারণে দেশে হয়েছে দীর্ঘ লকডাউন। পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হওয়ায় এখন চলছে আনলক পর্ব। তবে সব কিছু কবে আবার আগের মত স্বাভাবিক হবে সেই বিষয়ে নেই কোনো নিশ্চয়তা। লকডাউনের কারণে অনেকে কাজ হারিয়েছেন , অনেকে আবার বদলে ফেলেছেন নিজেদের জীবিকা। আবার অনেকের জীবনে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা’। তাঁত শিল্পীদের জীবন ও তার ব্যতিক্রম নয়। করোনার প্রভাব পড়েছে তাদের জীবিকাতেও। তাই পুজোর মরসুমেও মন ভালো নেই তাঁত শিল্পীদের, লাউদোহা ব্লকের গৌরবাজার গ্রামের তাঁত শিল্পীরা এমনটাই জানালেন।
গ্রামের তাঁতীপাড়ায় প্রায় ৭০টি তাঁত শিল্পী পরিবারের বসবাস। তাঁত শিল্পী-ই এদের জীবিকা। একটা সময় সব কটি পরিবারই বংশ পরস্পরায় এই কাজের সাথে যুক্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে এই কাজের কদর ও লাভ কমে যাওয়ায় অনেক পরিবারই বংশ পরস্পরার এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন। তবুও এখনো পাড়ার পনেরো কুড়িটি পরিবার এই পেশাটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
শিল্পী সন্ধ্যা দালাল, বলরাম দালালরা জানান তারা মূলত তাঁতের ও তসরের শাড়ি, ওড়না ও গামছা তৈরি করেন। একটি কাপড় তৈরি করতে সময় লাগে তিন থেকে চারদিন। এক দিনে বেশ কয়েকটি গামছা তৈরি হয়। এই কাজের কাঁচামাল আসে বিহারের ভাগলপুর ও উড়িষ্যা থেকে। বাঁকুড়া ও আশপাশের জেলার মহাজনেরা হচ্ছে তাদের ক্রেতা। মরসুমের শুরুতেই মহাজনেরা শিল্পীদের অগ্রিম অর্থ ধার হিসাবে দিয়ে যান। উৎপাদিত জিনিস মহাজনদের মারফতে জেলার বিভিন্ন বাজারে পৌঁছে যায়। বলরাম বাবু স্মৃতিচারনা করতে গিয়ে বলেন অতীতে তাঁতশিল্পের কদর ছিল গোটা রাজ্য জুড়ে। তখন দিনরাত প্রতিটি ঘরে শাড়ি কাপড় তৈরীর কাজ চলত। মহাজনদের আসা-যাওয়া আর মাকুর ( তাঁত যন্ত্র ) শব্দে গোটা পাড়া গমগম করত। এখন সেসব অতীত, তাঁতশিল্পের সোনালী দিন হারিয়ে গেছে। বাজারে সস্তায় রকমারি শাড়ি চলে আসায় কদর কমেছে তাঁতের শাড়ির। মাকুর যন্ত্রে (হাতে চালিত কাঠের যন্ত্র ) একটি শাড়ি তৈরি করতে তিন থেকে চার দিন সময় লাগে। আর পাওয়ার লুম ( ইলেকট্রিক চালিত মেশিন ) যন্ত্রে একদিনে তিন চারটি শাড়ি উৎপাদন করা যায়। ফলে তার দাম কম হয়। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় তাঁতের শাড়ির কদর কমেছে বাজারে। সন্ধ্যা দেবী বলরাম বাবু ও অন্যান্য শিল্পীরা জানান , পুজো চলে এল অথচ এখনও তাদের হাতে কোনো কাজ নেই। করোনা অতিমারি ও লকডাউন এর কারণে ভিন রাজ্য থেকে কাঁচামাল আসছে না। উৎসবের অনিশ্চয়তার কারণে বরাত আসেনি মহাজনদের কাছ থেকে। ফলে হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। বর্তমানে কর্মহীন তারা। বলরাম বাবু আক্ষেপের সাথে বলেন, এই অনিশ্চয়তার কারনে বংশ-পরম্পরার এই পেশা থেকে মুখ ফেরাছে বর্তমান প্রজন্ম। তারা অন্য কাজকে জীবিকা হিসাবে বেছে নিচ্ছে । শিল্পীদের ক্ষোভ, অন্যান্য শিল্পের সাথে যুক্তরা সরকারি ভাতা পেলেও তারা সেই ভাতা পাচ্ছেন না। এই প্রসঙ্গে লাউদোহা ব্লকের বিডিও মৃণাল কান্তি বাগচী জানান শিল্পীদের জন্যই রাজ্য সরকারের ভাতা প্রকল্প রয়েছে। তবে তার সুবিধা পেতে হলে আবেদন করতে হয়। সঠিক পদ্ধতিতে আবেদন করলে গৌরবাজার এলাকার তাঁতশিল্পীরাও যাতে সরকারি ভাতা পান সেই ব্যাপারে তিনি উদ্যোগ নেবেন বলে জানান মৃনাল কান্তি বাগচি।