আসানসালের প্রাচীন পুজোর ইতিহাস, যা আধুনিকতায় যায়নি হারিয়ে
আমার কথা, আসানসোল, ১৭ অক্টোবর:
সুদীপ্ত রায় (অধ্যাপক, টিডিবি কলেজ, রানীগঞ্জ)
এসেছে শরৎ, কিছুদিনের মন খারাপ করা বৃষ্টি চেনা ছন্দের ব্যঘাত ঘটালেও প্রকৃতি আবার তার নিজের ছন্দে। বাইপাসের ধারে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশের সারি শিল্প শহরের মন মাতাচ্ছে। চলছে ক্যামেরার ক্লিক, স্যোশাল মিডিয়ায় আপডেট। তবে এই শহরে আধুনিকতার সাথে মিশে আছে সাবেকিয়ানা। নতুনের সাথে আছে প্রাচীনের সহাবস্থান। রাঢ় বাংলায় মনসা,শীতলা, চন্ডী পুজোর দীর্ঘ ইতিহাস আছে৷ দুর্গাপূজা ততটা প্রাচীন নয়। আমরা বর্তমানে যেভাবে দুর্গাপূজা করি তার প্রচলন করেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ১৭২৮ থেকে ১৭৮২ সালের মধ্যে। তারপর সারা বাংলা জুড়ে প্রচলন হয় দুর্গাপুজোর। কথিত আছে প্রায় এই সময় ১৭৩৪ সালে আসানসোল শহরেও দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। যা এই বছর ২৮৯ বছরে পা রাখতে চলেছে। শুনলেই বোঝা যায় ইতিহাসের বহু ঘটনার সাক্ষী এই পুজো। কিন্তু কেমন ছিলো শুরুর সেই দিনগুলো? আসানসোলের এই এলাকা শহরের প্রাচীনতম জনপদ। তাই শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হলেও এর নাম আসানসোল গ্রাম। ১৭৩৪ সালের আগে এখানে চৈত্র শেষে শিবের গাজনের প্রচলন ছিলো। মাটির মন্দির এবং একচালা প্রতিমা নিয়ে অনাড়ম্বর ভাবে শুরু হয় দুর্গাপুজো। প্রথমে ছিলো বড়ো দুর্গামন্দির এবং মেজ দুর্গামন্দির। ১৭৭৪ সালে কোলিয়ারি প্রতিষ্ঠার পর মন্দিরে বসে টিনের চালা। ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং শরিকি বিভাজন থেকে এই এলাকায় গড়ে ওঠে আরো বেশ কয়েকটি মন্দির। বর্তমানে এই এলাকায় রয়েছে ৯ টি দুর্গা মন্দির। দুটি বাদ দিয়ে প্রতিটি পুজোই শরিকি পুজো, প্রায় প্রত্যেকটি মন্দিরের রয়েছে নিজস্ব সম্পত্তি। সেখান থেকে সারা বছর যা আয় হয় তাতেই পুজোর খরচ বহন করা হয়। পুজোকে কেন্দ্র করে চাঁদার জুলুম নেই এই এলাকায়। পুজোর ব্যপার তদারক করেন আসানসোল গ্রাম দুর্গোৎসব কমিটি এবং নীলকন্ঠেশ্বর জিউ দেবোত্তর ট্রাস্ট। তবে শুরুর দিকে এইরকম ব্যপার ছিলো না। অষ্টমির বলি শুরু হলে বন্দুকের গুলির শব্দে জানান দেওয়া হতো সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে বুধা গ্রামকে। সাথে সাথে শুরু হয়ে যেতো তাদের পুজো আচার। মাঝে বসতি কম থাকায় এবং গাড়ির শব্দ না থাকায় গুলির শব্দ অনায়াসে পৌঁছে যেতো বুধা গ্রামে। আজকের দিনে যা কল্পনা করা অসম্ভব। বহু বছর আগে নবপত্রিকা নিয়ে আসা থেকে শুরু করে তার বিসর্জন, প্রতিমা বিসর্জন মন্দির গুলোর নিজের উদ্যোগেই হতো। পরবর্তী সময়ে দেবোত্তর ট্রাস্টের উদ্যোগে দুর্গোৎসব কমিটি গঠন করে পুরো ব্যপারটা নিয়ে আসা হয় এক ছাতার তলায়। বর্তমানে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ যখন একান্নবর্তী ভাঙনের ছবি তখন আসানসোল গ্রামের এই ঘটনা বিপরীতমুখী। এ যেন ভাঙন কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সঙ্গ বদ্ধ হবার দৃষ্টান্ত। বর্তমানে নব পত্রিকা নিয়ে আসা তার বিসর্জন, প্রতিমা বিসর্জনে নয়টি মন্দির একসাথে সামিল হয়।বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় আতসবাজি দেখতে রামসায়র ময়দানে উপস্থিত হন শহরের বহু মানুষ। সবশেষে এই কথা বলা যেতেই পারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পুজোর সংখ্যা বাড়লেও এই এলাকার পুজো প্রাচীনত্বের সাথে আধুনিকতার মিশেলে আজও উজ্জ্বল।