শারদ অর্ঘ্য ও পুজোর গানের ইতিবৃত্ত
আমার কথা, বিশেষ প্রতিবেদন:
রীতা সাহা দে
সময় অদলায়, সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় অনেক কিছুই। মানুষের জীবনের মত প্রকৃতিতেও এখন এসেছে অনেক পরিবর্তন। আগে একতানা বর্ষণ আর কালো মেঘে ঢাকা আকাশের উজ্জ্বল সোনালী রঙ লাগত তখনই বোঝা যেত “এসেছে শরৎ, হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে/ সকালবেলায় ঘাসের আগায় শিসিরের রেখা ধরে…”। এদিকে ওদিকে মাঠের প্রান্তে সাদা কাশ ফুলের মাথা দোলানো আর দূর থেকে ভেসে আসা শিউলির সুঘ্রাণ আসন্ন উৎসবের বার্তা বয়ে নিয়ে আসত। আজ পরিস্থিতির যতি পরিবর্তন হোক, বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর আনন্দের কোনো তুলনাই চলে না। পুজোর সাথে জড়িত নতুন পোশাক, প্যান্ডেলে প্যান্ডেল ঘুরে প্রতিমা দর্শণ, একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া, পুজোর সাহিত্য পত্রিকা এবং অবশ্যই হৃদয় ভরানো, মন রাঙানো, স্মৃতি উদবেল করা পুজোর গান। বাঙ্গালীর সঙ্গীত প্রেম চিরকালীন আর বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ পুজোর বাংলা গান।
১৯১৪ সালে পুজোর গান শুরু করে গ্রামাফোন কোম্পানী। কলম্বিয়া ও দ্য গ্রামাফোন কোম্পানী আলাদা আলাদাভাবে তেদের রেকর্ড প্রকাশ করতো। পুজোর গানের বই প্রকাশিত হত সম্ভিবত ১৯৩০ সাল থেকে। বইয়ের নাম ছিল পুজোর গান। ১৯৫২ সালে দ্য গ্রামাফোন কোম্পানী ও কলম্বিয়ার সংযুক্তি ঘটে-গড়ে ওঠে এইচ.এম.ভি। পুজোর গানের বইয়ের ভূমিকায় লেখা হয়-সুর নিয়ে আমাদের কারবার- সেই সুরের ডালি সাজিয়ে আমরা উপহার দিই প্রতি বৎসর বাংলার সংগীত রসজ্ঞদের। ১৯৫৩ সালে এইচ.এম.ভি শারদীয়া বইটি আমূল বদলে হল এই এম ভি শারদ অর্ঘ(তখন দাম তিন টাকা)। এই নাম আর বদলায়নি। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত্য বইয়ের আকার ছিল ১/৮ ডি এম আই মাপে। ১৯৬৯ থেকে শারদ অর্ঘ্য এ ফোর ল্যান্ডস্কেপ ফরম্যাটে ছাপা হয়। ১৯৬৯ তে আবার এ ফোর পোর্ট্রেট আকার নেয়। প্রায় সব সময়ই শারদ অর্ঘ্যর প্রচ্ছদে মা দুর্গার ছবি প্রাধান্য পেতো। কখনও বা ঢাক বাদ্যরত ঢাকিদের ছবি, কখনও পুজো উপাচারের আনুষাঙ্গিক সহ সপরিবারে পার্বতীর ছবি, কখনও বিভিন্ন শ্লোক বা মন্ত্র। রেকর্ড করা এইসব গান সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার প্রথম ও প্রধান ভূমিকা ছিল আকাশবানীর। বয়স্ক মানুষদের আজও মনে পড়বে রবিবার দুপুর ১টা আর বুধবার রাত সাড়ে ৯টার সময় অনুরোধের আসরের কথা। সেই অভিনব ভাললাগা, সেই উন্মাদনা আজও অনুভব করতে পারি। বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকেই সেই বছরের নানান পুজোর গানের টুকরো অংশ শুনিয়ে শুনিয়ে শ্রোতাদের আকর্ষণ করা হতো। মহালয়া থেকেই কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, ছোটদের গানে সনত সিংহ, কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তি(সঙ্গে রচনাকার অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের ছবি ইত্যাদি সবই থাকতো), ভানু বন্দোপাধ্যায়ের হাস্য কৌতূক, বেহালায় দিলীপ রায়, ইলেক্ট্রিক গীটারে সুনীল গঙ্গোপধ্যায় ইত্যাদি সবই থাকতো। সম্ভবতঃ ১৯৮৮ সালেই শেষবারের মত প্রকাশিত হয় শারদ অর্ঘ্য। তারপর ১০/১২টি গান সহ ক্যাসেটের যুগ শুরু হল।
শিল্পী, গীতিকার, সুরুকার ত্রিবেণী সঙ্গমে কি অসাধারন সব গান সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৪৯ সালে সলিল চৌধুরীর সুরে সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের কবিতা অবলম্বনে হেমন্ত মুখোপধ্যায়ের গাওয়া রানার। ১৯৫০ সালে যূথিকা রায় পুজোর রেকর্ড করলেন-“এমনই বরষা ছিল সেদিন”(কথা-প্রণব রায়, সুর-কমল দাশগুপ্ত)। ১৯৫৩ সালে এক বিখ্যাত গায়কের আবির্ভাব হল-গাইলেন “কতদুরে আর নিয়ে যাবে বলো” এবং “হায় হায় গো রাত যায় গো”{কথা গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার সুর শিল্পীর নিজের)-তিনি মান্না দে। ১৯৫৪ এর উত্তাল সময়ের প্রেক্ষিতে সলিল চৌধুরীর বিখ্যাত “ধিতাং ধিতাং বোলে” এবং সুরকার অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় সৃষ্টি করলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দের কবিতা থেকে “ছিপখান তিন দাঁড়”। ১৯৫৭ তে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের “আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি”। সন্ধ্যা মুখোপধ্যায়ের প্রথম পুজোর গান ১৯৪৮ সালে। ১০৫০ সালে “ওগো মোর গীতিময়”। নির্মলা মিশ্র, আরতি মুখোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত, হৈমন্তী শুক্লা, দ্বিজেন মুখোপধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধায়, উৎপলা সেন, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, আলপনা বন্দোপাধ্যায়, তরুন বন্দোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, ইলা বসু-প্রত্যেকেই স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। ১৯৫৩ সালে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় পুজোয় গাইলেন দুটি অবিস্মরনীয় গান-কবি বিমলচন্দ্র ঘোষের কবিতায় সলিল চৌধুরীর সুরে”উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা” ও সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে “আয় বৃষ্টি ঝেঁপে”। জটিলেশ্বর মুখোপাধায় ১৯৬৩ সালে সুধীন দাসগুপ্তের কথা ও সুরে প্রথম পুজোর গানের রেকর্ড করেন। ১৯৫৭ সালে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় নিজের সুরে পুজোয় গাইলেন “আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি”(কথা শ্যমল গুপ্ত)। ১৯৬৫ সালে পুলক বন্দোপাধ্যায়ের অনুরোধে রাহুল দেববর্মণ সুরারোপ করলেন পুজোর গানে-“আমি বলি তোমায় দূরে থাকো” ও “আমার মালতীলতা”। এর আগে লতা মঙ্গেসকরের প্রথম পুজোর গান ১৯৫৭ সালে-“রঙ্গিলা বাঁশিতে” ও “মনে রেখো”-কথা পুলক বন্দোপাধ্যায় সুর ভূপেন হাজারিকা। ১৯৬৭তে কিশোরকুমারকে দিয়ে প্রথম পুজোর গান গাওয়ালেন রাহুল দেববর্মণ-“একদিন পাখি উড়ে যাবে”। ১৯৬৯ সালে প্রথম নিজের সুরে গান রেকর্ড করলেন রাহুলদেব-“মনে পড়ে রুবি রায়”। ১৯৭৬ এ এক কালজয়ী শারদ অর্ঘ্য “আয় খুকু আয়”-পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায় ভি বালসারার সুরে গাইলেন হেমন্ত মুখোপধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদার। তালিকা শেষ হবার নয়। সমুদ্রের অফুরান মনিমানিক্য থেকে মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করলাম। অভিনেতারাও অনেকে পুজোর গান গাইলেন। বিশ্বজিৎ(তোমার চোখের কাজলে), শুভেন্দু চট্টোপাধায়(এই আশা নদীর কূলে, সেই পলাতক পাখি)।
মহালয়ার সঙ্গে যে অনুষ্ঠান বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে – যে অনুষ্ঠান শুনে দীর্ঘ নব্বই বছর ধরে বাঙালি অভ্যস্ত – সেটি হল ‘ মহিষাসুরমর্দ্দিনী ‘। মহালয়ার প্রাক্ প্রত্যুষে আকাশবাণী থেকে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানের উৎপত্তি হয় ১৯৩০ সালে চৈত্রের শুক্লা অষ্টমীর প্রভাতে। শ্রী শ্রী মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর ওপর ভিত্তি করে ‘ বসন্তেশ্বরী ‘ নামে একটি চম্পু কাব্য (অর্থাৎ গদ্য পদ্য মিশ্রিত কাব্য) সম্প্রচারিত হয়। অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়ায় ষষ্ঠীর ভোরে সংস্কৃত রূপকের অনুসরণে রচিত oratorio বা বীথি ‘ মহিষাসুরমর্দ্দিনী ‘ প্রচারিত হয়। ১৯৩২ সাল থেকে এই অনুষ্ঠান শারদীয়া পূজার অঙ্গ হয়ে গেছে। বাণীকুমার অর্থাৎ বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্যর ভাষা ও গানের মাধুর্য, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সুনির্বাচিত সুরের মূর্ছনায় এবং অদ্বিতীয় গ্রন্থিক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর প্রকাশভঙ্গী – এই ত্রিবেণীসঙ্গমে ধীরে ধীরে অন্ধকারের অবসান ঘটিয়ে শ্রোতাদের হৃদয় – শতদলকে উন্মীলিত করে তোলে।