ক্যানসারে আক্রান্ত স্বামী লক্ষ্মীন্দরকে যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনলেন ‘বেহুলা’
আমার কথা, মুনমুন দত্ত, ৮ মার্চ:
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পায়েলকে “আমার কথা” পরিবারের পক্ষ থেকে জানাই অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন
মনসামঙ্গল কাব্যে স্বামী লক্ষীন্দরের জীবন যেভাবে বাঁচিয়ে ছিল বেহুলা, বাস্তব জীবনে পায়েল ও সেরকম একজন। দুরারোগ্যে আক্রান্ত প্রেমিককে সুস্থ করে তুলে তাকে বিয়ে করেছেন, জীবিকার লড়াইয়ে রয়েছেন স্বামীর পাশে। এই কারণে প্রকৃত সহধর্মিনী অর্ধাঙ্গিনীর দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন উখড়া গ্রামের পায়েল।
সমাজের আর দশটা মেয়ের মতোই পায়েলও একজন। তবে স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা, আত্মবিশ্বাস আর নিজের চেষ্টায় কিছু করে দেখানোর সংকল্পে সে অনন্যা। ২০১৬ সালে উখড়া গ্রামের সুকো পাড়ার বাসিন্দা পায়েলের বিয়ে হয় একই গ্রামের চাষা পাড়ার যুবক পিন্টু নন্দীর সাথে। একই গ্রামের হওয়ার কারণে বিয়ের আগে থেকেই দু’জন দু’জনের পরিচিত ছিল। স্কুল জীবনে একই শিক্ষকের কাছে টিউশন পড়ার সুবাদে দু’জনের প্রথম পরিচয়। সেখানেই একে অপরকে ভালোলাগা থেকে সম্পর্ক পৌঁছাই ভালোবাসাতে। যখন দু’জনের চুটিয়ে প্রেম করার সময় ঠিক তখনই ঘটলো প্রথম বিপর্যয়। এই সময় পিন্টুর গালে একটি ফোঁড়া হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তা থেকে প্রথমে মুখ পরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে ইনফেকশন। চিকিৎসা পরিভাষাতে এই রোগকে বলে পেনপিগাস ভাইরাস। রোগ থেকে মুক্তি পেতে বহু চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা করিয়েও হয়নি বিশেষ কোন লাভ। এক সময় বর্ধমানের এক চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন পিন্টু ও তার পরিবার। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চিকিৎসক জানিয়ে দেন সে ক্যান্সারে আক্রান্ত। যা শুনে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে পিন্টুর পরিবার ও পায়েলের মাথায়। ইনফেকশন দ্রুত ছড়াতে থাকে, খসে পড়তে থাকে শরীরের চামড়া। সাধারণত এই সময়ে অনেকেই দূরে সরে যায়। কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পায়েল সিদ্ধান্ত নেয় যেমন করেই হোক প্রেমিক কে সে সুস্থ করে তুলবেই। এই সময় পিন্টুর চিকিৎসা চলছিল বাড়িতে থেকেই। চিকিৎসকের নির্দেশমতো দীর্ঘদিন তাকে শুয়ে থাকতে হয়েছিল কলাপাতার উপর। স্কুল টিউশন যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বের হয়ে পায়েল চলে যেত পিন্টু দের বাড়ি। সে নিজের হাতে করত চিকিৎসকের নির্দেশ মতো অসুস্থ পিন্টুর শুশ্রুষা। দিনের পর দিন সে করেছে এই কাজ। এরপর ২০১৬ সালে চিকিৎসার জন্য পরিবারের লোকেরা পিন্টুকে নিয়ে পাড়ি দেয় দক্ষিণ ভারত। বাড়িতে না বলেই তাদের সফর সঙ্গী হয় পায়েলও। সেই সময় পায়েল একাদশ শ্রেণির ছাত্রী, পিন্টু সদ্য উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি বেরিয়েছে। সেখানকার চিকিৎসকরা আশার বাণী শোনায়, পিন্টু সুস্থ হয়ে যাবে, ভরসা দেয় সেখানকার চিকিৎসকেরা। সেই সফরের সময় তামিলনাড়ুর একটি মন্দিরে তারা বিয়ে করেন। দুশ্চিন্তা পুরোপুরি না কাটলেও বিয়ের মাধ্যমে তাদের ভালোবাসা পায় পূর্ণতা। চিকিৎসা আর পায়েলের শুশ্রুষার একদিন রোগ মুক্ত হয় পিন্টু। স্বামীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলার মাধ্যমে শেষ হয় পায়েলের লড়াইয়ের একটি অধ্যায়।
এরপর শুরু হয় অন্য এক লড়াই। সুস্থ হওয়ার পর পিন্টু রোজকারের খোঁজে যোগ দেয় দুর্গাপুরের একটি ফাস্টফুড সংস্থাতে। কিছুদিন সেখানে কাজ করার পর উখড়া বাজারে এক বন্ধুর সাথে শুরু করে ফাস্টফুড ব্যবসা। কিছুদিন পরই উখরা বাজপায়ী মোড়ে দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে শুরু করে নিজের ফাস্টফুড ব্যবসা। ঠিক এক বছরের মাথায় দোকান মালিক দোকান ঘর ফেরত নিলে সেই ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই পায়েল ও পিন্টু একসাথে শুরু করে চলমান ফাস্টফুডের দোকান। যাকে বলা হয় ফুড ডারপার্ক। এর জন্য কেনা হয় একটি ছোট চার চাকার গাড়ি। তাকে রূপ দেওয়া হয় দোকানের মত। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত্রি পর্যন্ত উখরা সার্কাস মাঠের সামনে দেখা যায় দাঁড়িয়ে থাকতে সেই চলমান ফাস্টফুডের দোকান। কিছুদিনের মধ্যে ব্যবসা জমে যাওয়ায় মিটেছে আর্থিক দুশ্চিন্তা। এরই মাঝে ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছে তাদের পুত্র সন্তান। পূর্ণতা পেয়েছে পায়েলের নারী সত্তা। দীর্ঘ লড়াইয়ে দেখা দিয়েছে দাম্পত্য জীবনে আশার আলো। এতদিন পায়েলের এই লড়াই সকলের কাছে ছিল অজানা। সম্প্রতি বাংলা টেলিভিশনের জনপ্রিয় টিভি শো দিদি নম্বর ওয়ানে ডাক পেয়েছিল এই দম্পতি। সেই টিভি শো এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে পায়েলের কঠিন লড়াইয়ের কথা।
পিন্টু বলেন পায়েল শুধু আমার স্ত্রী নই ও আমার জীবনে আশীর্বাদ। ও না থাকলে হয়তো বাঁচতাম না এতদিন। ওই আমাকে সুস্থ করে তুলেছে। ও শুধু আমার স্ত্রী নই, রোজকারের কঠিন লড়াইয়ে ও আমার সহকর্মীও। পায়েল বলেন লড়াইটা কঠিন ছিল ঠিকই, কিন্তু আত্মবিশ্বাস আর সংকল্প দৃঢ় থাকলে যে কোন লড়াইয়ে জয় আসে এই বিশ্বাস ছিল আমার। সে বলে অন্য মেয়েদেরও আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে, কারণ জীবন মানেই লড়াই। লড়াই জিততে গেলে আত্মবিশ্বাস ভীষণ প্রয়োজন।