বিশ্বকবির মানস চিত্রপটে নারী
আমার কথা, বিশেষ প্রতিবেদন, ১৬ ফেব্রুয়ারী:
সংঘমিত্রা দাশগুপ্ত
ছবি সৌজন্য: অদ্রিজা দাস
ছোটবেলায় রবিঠাকুরের সাথে আমার খুব একটা ভাব ছিল না। সহজপাঠের হাত ধরে প্রথম আমার তাঁর সাথে পরিচয়। মা বলেছিলেন-” ইনি আমাদের বিশ্বকবি”। সেই বয়সে বিশ্বকবিকে উপলব্ধি করার ক্ষমতাও ছিল না, করতেও পারিনি। এখনই বা কতটুকু পেরেছি, সে প্রশ্ন থেকে যায় নিজের কাছেই। পাঠ্যসূচিতে থাকার জন্যই ধীরে ধীরে অমল, দইওয়ালা, মিনি, কাবুলিওয়ালা, ফটিক, বলাইরা আমার দুনিয়াতে ঢুকে পড়তে থাকে। এর পর পরিচয় হলো চন্দরা, নিরুপমাদের সাথে। তাদের দুঃখে দুঃখী হলাম আমিও। কেমন ঠাকুর তুমি ? এদের সব কষ্ট দূর করে দিতে পারলে না ? বিশ্বকবির লেখার মাহাত্ম্য বোঝার ক্ষমতা তখন সেই কিশোরীর কোথায়? এইরকম দুঃখের গল্প যিনি লেখেন, তাঁর লেখা আর পড়বো না ঠিক করলাম। তারপর অনেকদিন রবি ঠাকুরের সাথে আমার সেরকম ভাব আর ছিল না, প্রায় আড়ির পর্যায়েই ছিল। এর পর হঠাৎ একদিন হোস্টেলের একলা ঘরে “দিনের শেষে ঘুমের দেশে” গানটা যেন মনকে ছুঁয়ে গেল।”ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে…..” এই পৃথিবীতে এইরকম মাঝখানে পড়ে থাকা লোকের সংখ্যা কম নয় বটে কিন্তু রবিঠাকুরের লেখা এই লাইনটি গানের সুরে শুনে কেন জানি না মনে হল যে এইরকম মাঝখানে পড়ে থেকে টানাপোড়েনের শিকার সমাজে নারীরাই বেশি হয়। মাথায় ভূত চাপলো, আর একের পর এক রবিঠাকুরের লেখা নারী চরিত্রগুলো শেষ করতে থাকলাম।
বিন্দুকে মরতে হলো মৃণালকে তার বেঁচে থাকার অনুভূতি দিতে। কথায় বলে মেয়েদের প্রাণ, কইমাছের জান। কিন্তু রবিঠাকুর বিন্দুকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেন না। একে তো মেয়েমানুষ, তায় আবার প্রায় অনাথ – এইরকম মেয়েরা সংসারে করুণার পাত্রী হওয়া ছাড়া আর তাদের কিছু প্রাপ্তি থাকতে পারে না। তাই তাকে মেরে ফেলা ছাড়া বিশ্বকবি আর কোন পথ খুঁজে পেলেন না। আবার মৃণালের বিদ্রোহিনী হওয়াই বোধহয় তার অপরাধ হয়ে গেল। বিদ্রোহিনীকে তিনি সংসার দিতে পারলেন না, তাই মৃণালকে সংসারকে বিদায় জানাতে হলো।বিদ্রোহিনীরা আজকের সমাজেও সংসার পায় না, রবিঠাকুর অনেক আগেই সমাজকে একটা উদাহরণ দিয়ে গেছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে।
চারুকে তার একাকীত্ব দূর করতে গিয়ে জীবনে মাশুল একটু বেশিই দিতে হলো। প্রিয় দেওরের থেকে কবিতা বেশি ভালো লিখে ফেলায় দেওর ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগে বৌঠাকরুণকে আরো বেশি একা করে দিয়ে বিদেশ যাত্রা করলেন। আর ওদিকে ভূপতির কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে চারু নিজের সংসারকে তাসের ঘরের মতো ভেঙে ফেললো। অমলের চারুর প্রতি আকর্ষণ খানিকটা যেন সাময়িক খেয়াল। কিন্তু পুরুষ মানুষের সাময়িক খেয়ালকে মাফ করে দিয়েছেন রবিঠাকুর।তাই হয়তো হঠাৎ করে অমলের মরালিটি জেগে ওঠে এবং লক্ষ্মী ছেলের মতো সে নিজে একটা সুন্দর জীবন বেছে নেয়। ভূপতিরও সেই রকম নিন্দা করার মতো কোন দোষ আছে বলে লেখক কিন্তু দেখাননি। পুরুষ মানুষ তো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই পারেন আর স্ত্রীর নূন্যতম চাহিদার দিকে খেয়াল রাখতে নাই পারেন কিন্তু তার জন্য কি স্ত্রী পরপুরুষে মন দেবেন? না, বিশ্বকবি সেই অনুমতি দেননি। রবিঠাকুরের কাছে অমল ভূপতি দুজনেই বিচক্ষণ কিন্তু চারু আমাদের সবার কাছে “বঞ্চনাকারিণী” হয়েই থেকে গেল। তাই নষ্টনীড়ের দায় শুধু চারুর ঘাড়েই বর্তালেন লেখক।
বিনোদিনী শুধু আশালতার চোখের বালি নয়, আজকের এতো আধুনিক সমাজেও বিনোদিনীর মতো মেয়েরা সবার চোখের বালি। অসাধারণ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষটি সেই কবেই এই চরিত্র গুলোর গল্প বলে গেছেন।আগ্রাসী মোহ নিয়ে জীবন কাটানো মহেন্দ্র বিনোদিনীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কিছু করুণার পাত্র হলো কিন্তু তাকে আর কোনরকম শাস্তি তাকে দিলেন না লেখক। আশালতা কবির কল্পনার নারীর প্রতিরূপ, কারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মানসী কবিতায় লিখছেন- ” শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী/ পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি/ আপন অন্তর হতে…….”আশালতা যেন বিধাতার নয়, পুরুষের ইচ্ছার প্রতিরূপ। খানিকটা ওই পতির পুণ্যে, সতীর পুণ্যের মতো ব্যাপার। মহেন্দ্রর হাতের পুতুলের মতো করে আশালতার ছবি এঁকেছিলেন তিনি এবং তাকে শেষ পর্যন্ত সুখী গৃহিণীর তকমা দিয়েছিলেন। ওদিকে সাহেবি শিক্ষায় শিক্ষিতা, আধুনিকা, স্বাধীনচেতা, নির্লজ্জের মতো নিজেকে মহেন্দ্রর কাছে সঁপে দেওয়া বিনোদিনীকে কিন্তু লেখক সমগ্র সমাজ সংসারের কাছে অপরাধী করে রেখে দিলেন।কবির কলমও বিনোদিনীকে রেহাই দিল না কারণ আশালতার মতো “লক্ষ্মী” মেয়ে যে সে নয়।
আবার কবির ঘরে বাইরে উপন্যাসের বিমলা নিখিলেশের গভীর প্রেমকে উপলব্ধি করতে পারলো না কিন্তু ড্যাশিং সন্দীপের হিরোয়িজমের প্রেমে পড়ে গেল। আচ্ছা, নারীর বিচার বুদ্ধির ওপর কি রবি ঠাকুরের কোন ভরসা ছিল না? ভালবাসার গভীরতা বোঝার ক্ষমতা আর বিশ্বস্ততা – এই দুটি গুণে নারীকে আঁকার সাহস কেন করেননি কবি? বিশ্বকবির কাছে মনে মনে প্রশ্ন করলাম- নারী কি আপনার কাছে চিরকালের অপরাধী? শুধুই কি সৌন্দর্যের বস্তু? তাই কি মানসী কবিতায় তিনি লিখলেন – ” কত বর্ণ কত গন্ধ ভূষণ কত- না/সিন্ধু হতে মুক্তা আসে খনি হতে সোনা/বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার/চরণ টাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার”- শুধু রূপের বর্ণনা, গুণের খোঁজ নেই সেখানে।
শেষের কবিতা শেষ করলেন তিনি বিচ্ছেদের মাঝে মিলন অথবা মিলনের মাঝে বিচ্ছেদকে নিয়ে। আজ এত বছর পর যখন শেষের কবিতা বার বার পড়ি, তখন মনে হয় কি বিচক্ষণতার সাথে রবি ঠাকুর অমিত আর লাবণ্যকে আলাদা করে দিয়েছিলেন, নাহলে শেষের কবিতা কখনোই “শেষের কবিতা” হয়ে উঠত না। তবে লাবণ্য আর কেটি- দুই নারী চরিত্রই যেন স্বমহিমায় ফুটে ওঠার থেকে ভালবাসার জন্যই শুধু নিবেদিত প্রাণ। ভালোবাসার পুরুষকে সাথে নিয়েও নারী নিজের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে কিন্তু লাবণ্য আর কেটির স্রষ্টার কলম তাদের ভাগ্য অন্যরকম করে লিখেছিল।
আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানে মৃণাল, চারু, চন্দরা, বিনোদিনী, আশালতা, বিমলা, লাবণ্য, কেতকীরা – নারীকে কখনো অসহায় আর কখনো অপরাধী করেও এত রূপ, রস, বর্ণে আর কেই বা বাঁধতে পেরেছেন? নারীর মনস্তত্ত্বকে এই নানাবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পক্ষেই সম্ভব। কথায় আছে – ” স্ত্রীয়াশচরিত্রম দেবা না জানন্তি” – তাই বিশ্বকবিও তাঁর লেখায় নারীকে অসহায়, অপরাধীর সাথে সাথে রহস্যময়ী করেও তুলে ধরেছেন। তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়- বিধাতা নারীকে অধিকার দিলেও, বিশ্বকবি কি সত্যিই তাঁর সৃষ্টি নারী চরিত্রদের আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার দিয়েছিলেন?