দেশীয় উদ্যোগের কান্ডারী মহাত্মা গান্ধী কি আধুনিক বিজ্ঞানের পরিপন্থী ছিলেন
আমার কথা, বিশেষ প্রতিবেদন, ১ আগস্ট:
সংঘমিত্রা দাশগুপ্ত
“Machinery has begun to desolate Europe. Machinery is the chief symbol of modern civilization ; it represents a great sin.” – Gandhi
হিন্দ্ স্বরাজে লেখা গান্ধীজীর এই বক্তব্য পড়লে যে কোন মানুষের মনে হতেই পারে যে তিনি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির কট্টর বিরোধী ছিলেন। আর একটু পিছিয়ে গিয়ে যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখা যাবে যে গান্ধীজীর জীবনের প্রথম পঞ্চাশটি বছর বিশ্বের ইতিহাসে বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সেরা সময় ছিল। ডারউইনের থিয়োরি অব্ ইভোলিউশন, ল অব্ ইলেকট্রোম্যাগনেটিশম্, পিরিয়ডিকাল টেবল – এই সব কিছু বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় একটা একটা করে পালক গুঁজে দিয়েছিল। এইরকম এক সময়ের সাক্ষী থেকেও, সেই সময় গান্ধীজী কিন্তু সেই অর্থে বিজ্ঞান মনস্কতার পরিচয় দেননি। ১৯১৫ সালে সাউথ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে এসে তিনি পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন অহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে।
১৯০৯ সালে হিন্দ্ স্বরাজ পত্রিকা গান্ধীজীকে বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক নন বলেই তকমা দেয়। গান্ধীজী বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তাঁর লিখিত মত প্রকাশ করলেও, তিনি বিজ্ঞানের অগ্রগতির জয়গান কখনো তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে করেননি। লক্ষণীয় বিষয় যে সাউথ আফ্রিকা থাকাকালীন তিনি বিজ্ঞানের অগ্রগতির সমালোচনা করেছিলেন কারণ তাঁর মতানুযায়ী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আসলে যুদ্ধের হাতিয়ার এবং মানুষকে মানবিক করে তোলার পক্ষে বিজ্ঞানের কোনো অবদান নেই। তাই তিনি বলছেন- “The boast about the wonderful discoveries and the marvellous inventions of science, good as they undoubtedly are in themselves, is, after all, an empty boast. They offer nothing substantial to struggling humanity.”
কিন্তু আস্তে আস্ত এই চিত্রের পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যায়। গান্ধীজীর এর পরবর্তী বিভিন্ন বক্তব্যে এটাই প্রাধান্য পায় যে, তাঁর বিরোধিতা বিজ্ঞানের সাথে নয়, বিজ্ঞানের যে অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে, তার সাথে তাঁর বিরোধিতা। ১৯২১ সালে, দিল্লিতে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন- ” My quarrel is not against that spirit. My complaint is against the direction that spirit had taken……for merely material advances.” এই সময়, গান্ধীজী এও বলেন যে, প্রযুক্তি বা বিজ্ঞানের জন্য তৈরী এমন কোন নেগেটিভ বিষয় বা ক্ষতিকর প্রভাব নেই, যা ঠিক করা যেতো না, শুধুমাত্র পজিটিভ মানসিকতার প্রয়োজন ছিল, সেই পজিটিভ পরিবর্তন আনার জন্য – ” no disturbance had been created by machinery that could not be corrected. It was a mental state that had to be put right.” গান্ধীজীর এই বক্তব্যের সাথে সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে গান্ধীজীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের একটা আভাস পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য বিষয় যে, ১৯২৯ সালে, তিনি একটি প্রতিযোগিতা রাখেন, যেখানে তিনি ঘোষণা করেন যে , এমন একটি চরখা মেশিন তৈরী করতে হবে যেটি তুলো থেকে সুতো তৈরী করতে পারবে এবং এর জন্য তিনি ১ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেন।
১৯২৫ সালে, ত্রিবান্দ্রমে দেওয়া একটি বক্তব্যে তিনি যা বলেছিলেন তার সারমর্ম এই যে , ভারতবর্ষে এবং ভারতবর্ষের বাইরে অনেকেই মনে করেন যে তিনি বিজ্ঞান বিরোধী – এটা ঠিক যে তিনি বিজ্ঞানের একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত নন , কিন্তু তিনি এটাও বিশ্বাস করেন যে বিজ্ঞানকে যদি সঠিকভাবে চালনা করা হয়, তাহলে বিজ্ঞান ছাড়া আমরা চলতে পারবো না। অর্থাৎ, এই সময় থেকে গান্ধীজী বিজ্ঞান এর সাথে মানব সভ্যতার সহাবস্থানকে মেনে নিয়েছিলেন, যদি না বিজ্ঞান মানবিকতার কোন ক্ষতি করে। যেহেতু তিনি অহিংসার পূজারী ছিলেন, তাই, বিজ্ঞানের মধ্যে দিয়ে যে ” violence” উঠে আসতে, তাকে তিনি কখনোই মেনে নিতে পারেননি। তিনি প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন যে কীভাবে বিজ্ঞানকে মানবকল্যাণ এবং সমাজের অগ্রগতির জন্য ব্যবহার করা যায় – ” just as some of the experiments in your laboratories go on for all the 24 hours, let the big corner in your heart remain perpetually warm for the benefit of the poor millions.”
অর্থাৎ, জীবনের শুরুতে, বা বলা ভাল তাঁর জীবনেরপ্রথম পঞ্চাশটি বছর বিজ্ঞানের বিষয়ে একদম বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করলেও, সময়ের এবং অভিজ্ঞতার সাথে সাথে তিনি তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিবর্তন করেছিলেন। সত্যের পূজারী বলে নিজেকে চিহ্নিত করা গান্ধীজী বলছেন যে ,তাঁর কাছে সত্য মানে কোন একটি বিশেষ ধারণাকে আঁকড়ে ধরে থাকা নয়, বরং নতুন অভিজ্ঞতার সাথে সাথে সেই সত্যকে নতুন ভাবে গ্রহণ করা। যিনি অভিজ্ঞতার সাথে সাথে পরিবর্তনকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন, তাঁকে হয়তো বিজ্ঞান বিরোধী তকমা দেওয়া যায় না। গান্ধীজীর কথা দিয়েই এই প্রতিবেদন শেষ করছি – ” I am not at all concerned with appearing to be consistent. In my search after truth , I have discarded many ideas and learnt many new things. What I am concerned with is my readiness to obey the call of truth.”
গান্ধীজী বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে আটকাতে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন বিজ্ঞান যেন মানবিক থেকে অগ্রসর হয়।।