“ইট ইস ইউর লস্ট চাইল্ড” ডাক্তারকে ভুল প্রমান করে আজ শিক্ষারত্ন পুরষ্কারে সম্মানিত স্বরূপা
আমার কথা, বিশেষ প্রতিবেদন, ১৮ আগস্ট:
“ইট ইস ইওর লস্ট চাইল্ড। একে নিয়ে কিচ্ছু করা যাবে না”-হ্যাঁ এই ছিল ডাক্তারের কথা একরত্তি স্বরূপাকে নিয়ে। কিন্তু বিধাতার বোধহয় অন্য পরিকল্পনা ছিল ওই শিশু কন্যাকে নিয়ে। অপরিসীম মনোবল নিয়ে, সমাজের নানা উপহাসকে উপেক্ষা করে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে আজ সেই সমাজের বুকেই নিজের এক আলাদা জায়গা করে নেওয়ার কাহিনী শুনবো স্বরূপার মুখ থেকে
আমি স্বরূপা দাস, থাকি বর্ধমানের নতুনপল্লীতে। ১৯৮৪ সালে আমার জন্ম। আমার জন্মের কিছু মাসের মধ্যে স্পাইনাল কর্ডে টিউমার ধরা পরে। মাত্র দশ মাস বয়সে অপারেশন হয় আমার, ডাক্তার বলেই দেন এই অপারেশন হলে হয় ব্রেন নষ্ট হবে নয় লোয়ার পার্ট নষ্ট হতে পারে। যা হওয়ার তাই হল। অপারেশন এর পর আমার কোমর থেকে পা পর্যন্ত প্যারালাইজড হয়ে যায়। কিন্তু এর জন্য আমার পড়াশোনা থেমে থাকেনি। স্কুলে পড়াশোনার সময় নানা প্রতিবন্ধকতা, উপহাসের মুখে আমাকে পড়তে হয়েছিল। আমি মাধ্যমিকে জেলায় প্রথম ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম কুড়িতে স্থান পাই। এরপরে বাংলায় অনার্স নিয়ে এম.এ ও তারপর বি.এড করি। ২০০৬ সালে এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে চতুর্থ স্থান অধিকার করে শিক্ষকতা করছি সতেরো বছর ধরে। হুইল চেয়ার ছাড়া আমি যাতায়াত করতে পারি না। কলেজে পড়ার সময় আমার একটা কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। সেই থেকে ক্যাথিটার আমার সঙ্গী, এছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। তবে এগুলো কখনোই আমার জীবনে বাধা নয় বরং অলংকার হয়েছে।
বর্তমানে আমি বর্ধমান রেলওয়ে বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতা করি। কিন্তু একটা সময়ে এই স্কুলে আমাকে তাঁরা নিতে চাননি কারন আমি হুইলচেয়ারে ছাড়া চলাফেরা করতে পারি না তাই। পরে আমার পড়ানো, স্কুলে বাংলা বিষয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল দেখে ও ছাত্রদের থেকে আমার পড়ানো নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলে ওনারা আমার প্রতি ভালো ব্যবহার করেন। তবে, এখন আমি আমার স্কুলে সকলের প্ৰিয় শিক্ষিকা, আমি আমার ছাত্রদের ফ্রেন্ড -ফিলজপার -গাইড হওয়ার চেষ্টা করি। শুধু পাঠদান নয় নৈতিক দায়বদ্ধতা শেখানোর চেষ্টা করি। আমি ২০১১ সালে সেরা কর্মীর সম্মান ও ২০১৪ সালে মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে শিক্ষা রত্ন পুরুস্কার পাই।
আমি যে স্কুলে পড়াশোনা করেছি, তার নাম বর্ধমান বিদ্যার্থী ভবন বালিকা বিদ্যালয়। আমার কলেজ হলো বর্ধমান রাজ কলেজ ও স্নাতকোত্তর করি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
জীবনে প্রচুর বাধা এসেছে, স্কুলে কিছু বন্ধু মজা করেছে, কলেজেও তাই কিন্তু কোনোদিন মনের জোড়কে হারতে দিই নি। আমি যে স্কুলে পড়তাম সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বলতেন —- “তোমার যা নেই, তা নিয়ে ভেবো না, যা আছে তা নিয়ে ভাবো , অনেক দূর যাবে “. এই কথাই আমার জীবনের চলার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়৷ আমি ভীষণ মজা করে হুইল চেয়ারে জীবন উপভোগ করে বাঁচি, আমার মতে একেকটা মুহূর্তে একেকটা জীবন বাঁচা যায়।
অনেকেই বলে আমি মা হতে পারবো না। আমি তাদের বলি আমি হাজার হাজার সন্তানের মা, প্রতি বছর আমি নতুন নতুন সন্তানের মা হই।
আমার পরিবার(বাবা, মা, বোন), আমার স্কুল, আমার সহকর্মীরা, আমার শখ যেমন বেড়ানো (কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা ঘোরা হয়ে গেছে, ) আড্ডা দেওয়া, নাটক করা, সিনেমা দেখা এর মধ্যেই বেঁচে থাকা।
আমি লেখা লিখি করি, আমার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে,,, নাম –“মনের দর্পনে”। এইসব নিয়েই আমি ও আমার জীবন।