দৃষ্টিহীনতা বাধা নয়, মনের জোরকে পাথেয় করে আজ আদর্শ শিক্ষক সঞ্জয় গোস্বামী
আমার কথা, পানাগড়, ৫ সেপ্টেম্বর:
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জীবনে বড় হওয়ার পথে কোনো বাধা হতে পারে না। তা হয়তো প্রমান করেছেন পানাগড় রেলওয়ে কলোনি উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরাজি শিক্ষক সঞ্জয় কুমার গোস্বামী। নিজের অদম্য ইচ্ছা শক্তি ও সাহসিকতাকে ভর করে তিনি আজ আদর্শ শিক্ষক।
ছাত্র ছাত্রী থেকে তার সহকর্মীরা প্রত্যেকেই মুগ্ধ তাঁর আচার,ব্যবহারে। জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন সঞ্জয়বাবু।
যার কারনে তার বাবাকে তার সহকর্মী থেকে প্রতিবেশী, প্রত্যেকের কাছ থেকেই সঞ্জয় বাবুর শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য নানা রকম কটূকি শুনতে হতো।
দিনের পর দিন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরতেন তিনি৷ তা সত্ত্বেও প্রতিবেশীদের এই সব কটূক্তিকে অবজ্ঞা করে ছেলেকে মানুষের মত মানুষ তৈরি করতে হবে এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষেই কলকাতার ব্লাইন্ড স্কুলে ভর্তি করেছিলেন সঞ্জয়বাবুর বাবা।
সেখান থেকেই মাধ্যমিক পাশ করেন সঞ্জয়বাবু। কর্ম সূত্রে তার বাবা বিবেকানন্দ গোস্বামী আসানসোলের কুলটিতে থাকতেন, সেই সূত্রে কুলটি স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে আসানসোলের বি.বি কলেজ থেকে ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে স্নাতক হন।
এর পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে স্নাতকত্তোর শেষ করে পুরুলিয়া থেকে বি.এড. করেন তিনি। ২০০৫ সালে স্কুল সার্ভিসের পরীক্ষায় পাশ করে স্কুল শিক্ষকের চাকরি পেয়ে কাজে যোগ দেন পানাগড় রেলওয়ে কলোনি হাইস্কুলে।
অনেক সংশয় ও আশঙ্কা নিয়ে কাজে যখন যোগ দেন।
তিনি বাদে বাকি সকলেই স্বাভাবিক। তাই প্রথম দিকে কিছুটা মানিয়ে নিতে অসুবিধা হলেও আস্তে আস্তে সব বাধা কাটিয়ে তিনি এখন ছাত্রছাত্রী দের কাছে একজন আদর্শ শিক্ষক।
অন্যান্য শিক্ষকদের থেকে তিনি কোনো অংশে কম নন। পড়াশুনোর পাশাপাশি গান, আবৃত্তি ও কম্পিউটার চালানোয় যথেষ্ট দক্ষ। ক্লাস চলা কালীন বোর্ডে লেখার কাজ টা কোনো এক ছাত্র বা ছাত্রী করে থাকে।
বাকি ইংরাজী গদ্য বা পদ্য কোন লাইনের কি মানে সেটা ছাত্র ছাত্রীদের সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন তিনি।
শুধু তাই নয়। তার ক্লাসের প্রতিটা ছাত্রের নাম কোথায় বাড়ি সবই তার মুখস্ত।
বিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রীদের যাতে পড়াশোনায় সমস্যা না হয় তাই বাড়িতে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কম্পিউটারে টাইপ করে ইংরেজিতে নোট তৈরি করেন সঞ্জয়বাবু।
একটি বিশেষ সফটওয়্যারের সাহায্যে কম্পিউটারে অনায়াসেই টাইপের কাজ শিখে নিয়েছেন তিনি।
এরই সাথে গান বাজনাও শিখেছেন তিনি। দুরদর্শনে প্রতিবন্ধী শিল্পী হিসেবে গানও করেছেন বহুবার। যার কারণে
বিদ্যালয়ে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলেই অনুষ্ঠানের পরিচালনার ভার পড়ে সঞ্জয় বাবুর উপরেই।
এক আধটা দিন শরীর খারাপ ছাড়া রোজই বিদ্যালয়ে হাজির থাকেন সঞ্জয়বাবু। সঞ্জয়বাবুর পান্ডিত্যে মুগ্ধ স্কুলের প্রধান শিক্ষকও। তিনি যথেষ্টই গর্বিত তাঁর মতো একজন শিক্ষককে সহকর্মী হিসাবে পেয়ে। প্রতিদিন স্কুলে পৌঁছানো থেকে ছুটির পর বাড়ি পৌঁছানোর কাজটা করে যত্ন সহকারে কখনও তার দিদি বা কখনও বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। তবে বর্তমান সমাজে যেভাবে শিক্ষাঙ্গন কুলষিত হচ্ছে তাতে তিনি যথেষ্টই ব্যথিত।
তাঁর অভিমত এটা সামাজিক অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই না। বর্তমান সমাজে সঞ্জয় বাবুদের মতো শিক্ষকদের দেখা পাওয়া খুবই দুষ্কর। শিক্ষক দিবসের দিনে এই আদর্শ শিক্ষকের প্রতি রইল আমাদেরও শ্রদ্ধা।