পত্র পত্রিকার শারদীয়ার পুজোর সংখ্যা
আমার কথা, বিশেষ প্রতিবেদন:
রণজিৎ গুহ
আমরা বলতাম পুজো সংখ্যা। তারপর অসাম্প্রদায়িক লোকজন বলতে শুরু করলেন উৎসব সংখ্যা। উৎসবের আবার ধর্মীয় ভেদাভেদ আছে। অতএব নাম হল শারদসংখ্যা। (কেন জানিনা তাতেও লিঙ্গ ভেদাভেদ। দেশ পত্রিকা শারদীয় আনন্দবাজার শারদীয়া) প্রধানত লিটিল ম্যাগাজিন সম্পাদকরা এবং আরও এগিয়ে থাকা মানুষজন বলেন বিশেষ সংখ্যা। সে কিছু মন্দ নয়। এভাবে যদি খানিকটা সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ঠেকানো যায় সে বেশ কথা।
হুমড়ি খেয়ে পুজো সংখ্যা পড়ার বয়সকালে ছোটবড় পত্রিকার পুজো সংখ্যার বিজ্ঞাপনে জানানো হত মহালয়ার আগেই প্রকাশিত হবে। এখনতো দেখি সেসব পুজো সংখ্যা রাখিপূর্ণিমার আগেই প্রকাশিত হয়ে দোকানে দোকানে গ্রাহক- পাঠকের অপেক্ষায় ঝকমক করে। দৈনিক সাপ্তাহিক মাসিক পত্র পত্রিকার পুজো সংখ্যা ছাড়াও দেব সাহিত্য কুটির থেকে বেরোত পূজা বার্ষিকী। পুজোয় নতুন জামাপ্যান্ট এর মত অধীর আগ্রহে ছোটরা অপেক্ষা করত এই পূজাবার্ষিকীর জন্যও।
যতদূর যা জানা যায় সম্ভবত, কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ভারত সংস্কার সভার সাপ্তাহিক ‘সুলভ সমাচার’ পুজোর ছুটির আগে আগে পুজো সংখ্যা প্রকাশ করে ‘ছুটির সুলভ’ নামে। এক পয়সার সেই বিশেষ সংখ্যা বেরোয় ১২৮০-এর আশ্বিন মাসে। এই বিশেষ সংস্করণ এর নাম অবশ্য ঘোষিত ভাবে পুজো সংখ্যা ছিল না।
প্রকাশিত হবার ঠিক দশদিন আগে অর্থাৎ ১লা আশ্বিন এই বিশেষ সংখ্যাটির একটি খুব সুন্দর বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকায়।
**********
‘ছুটির সুলভ!!! ছুটির সুলভ!!!
আগামী ছুটি উপলক্ষে সুলভের বিশেষ একখণ্ড বাহির হইবে।
উত্তম কাগজ, উত্তম ছাপা। দাম কিন্তু ১ পয়সা।
মজা করিয়া পড়িতে পড়িতে ঘরে যাও। একটা পয়সা দিয়ে সকলের কিনিতেই হইবে।
দেখ যেন কেউ ফাঁকি পোড় না।’
************
‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকার এই বিজ্ঞাপনটিই পুজো সংখ্যার প্রথম বিজ্ঞাপন হিসাবে ধরা যেতেই পারে।
‘সুলভ সমাচার’ এর আইডিয়া অনুসরণ করে পুজোর সময় ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’–এ প্রকাশিত হত দুর্গাপুজোর উপর বেশ কিছু পদ্য। অবশেষে বাংলার ১৩২০ সালে ‘মাসিক ভারতবর্ষ’ পত্রিকা তাদের আশ্বিন মাসের সংখ্যাটি একটু বৃহৎ আকারে অনেক খ্যাতিমান লেখকদের লেখায় সমৃদ্ধ করে পুজো সংখ্যা হিসাবে প্রকাশ করে। ওই সংখ্যায় লিখেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, নিরুপমা দেবী প্রমুখ তৎকালীন লেখকগণ। ১৯২২ সালে ‘মাসিক বঙ্গবাণী’ নামে একটি পত্রিকা তাঁদের পুজো সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করে অমরকথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পটি। ‘বসুমতী’ পত্রিকা ১৯২৫ থেকে ১৯২৭ পর পর তিনবছর পূজাসংখ্যা হিসেবে ‘বার্ষিক বসুমতী’ প্রকাশ করে। সম্পাদক ছিলেন সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও সত্যেন্দ্রকুমার বসু। মাসিক বসুমতী পত্রিকার আলাদা পুজো সংখ্যা পাঠক মহলে বিশেষ সাড়া ফেলে দেয়। ‘মাসিক বসুমতী’ সর্বপ্রথম তাদের পুজোসংখ্যাতে প্রকাশ করে একটি উপন্যাস যা আগে কোনো পত্র পত্রিকার পুজো সংখ্যায় দেখা যায়নি। বসুমতীর ১৯২৭ সালের পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক, ‘পরিত্রাণ’ এবং চারুচন্দ্র সেনগুপ্তের আঁকা মা দুর্গার একটি রঙিন ছবি। ঠিক সেইসময় ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব পত্রিকা ‘ভারতী’-র পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয় তাদের পুজোসংখ্যা যার দাম ছিল এক টাকা। এই সংখ্যার প্রধান আকর্ষণ ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেনা-পাওনা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘ষোড়শী’, যেটির নাট্যরূপ দিয়েছিলেন হাসির রাজা শিবরাম চক্রবর্তী এবং পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘ভারতী’ নামের একটি কবিতা। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা পুজো উপলক্ষে দুই পাতার আলাদা একটা সংস্করণ
প্রকাশ করে ১৯২২ সালে। যা বিনামূল্যে দৈনিক কাগজের সাথে দেওয়া হয়েছিল। পুজোসংখ্যা হিসাবে এর আলাদা গুরুত্ব বোঝানোর জন্য পৃষ্ঠার লেখাগুলি লালকালিতে ছাপা হয়েছিল। বেশ কয়েকবছর বিনামূল্যে পুজোসংখ্যা কাগজের সাথে বিতরণ করার পর ১৯২৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা প্রথম আলাদাভাবে ৫৪ পাতার একটি পুজোসংখ্যা প্রকাশ করে এবং দাম ছিল দুই আনা কিন্তু সেটা ছিল ছবিহীন, লালকালিতে ছাপা। কোনো উপন্যাসের বালাই ছিল না, শুধুই প্রবন্ধ।
বেশ কিছু বছর পর তাতে প্রথম উপন্যাস ছাপা হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরতলী’ , রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত বড় গল্প ‘রবিবার’ প্রকাশিত হয় এখানেই। পরের বছরে ১৩৪৭সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘ল্যাবরেটরি’ ( ল্যাবরেটরি উপন্যাস কিনা তা নিয়ে অবশ্য এক খল বিতর্ক আছে)। দেশ পত্রিকার পুজো সংখ্যা প্রথম প্রকাশ পায় আনন্দবাজার পত্রিকার পুজো সংখ্যা প্রকাশের আট বছর পরে ১৩৪১ বঙ্গাব্দে। সুবোধ ঘোষের ‘ত্রিযামা’ ছিল দেশ-এ প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস, যা বেরিয়েছিল ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে। ক্রমে সেই সময়ের অন্য দৈনিক সাপ্তাহিক মাসিক পত্রিকা গুলোও নিয়মিত পুজো সংখ্যা বের করতে শুরু করে।এমনকি ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যান, হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড দুর্গাপুজোর আগে ইংরেজি ও বাংলায় এনুয়াল ইস্যু নামে বিশেষ সংখ্যা বের করতো। হিন্দি দৈনিক সন্মার্গ কালীপুজোর আগে বিশেষ দীপাবলি সংখ্যা প্রকাশ করত।
রাজনৈতিক দৈনিক ও সাময়িক পত্রিকাগুলোও মুখে না বলেও পুজো সংখ্যা বের করতেন। পুজো সংখ্যা না বলেও লিটল ম্যাগাজিন সহ বিভিন্ন ছোট বড় পত্র পত্রিকা অন্য নামে আজও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে। ইতিমধ্যে পত্র পত্রিকার সংখ্যা বেড়েছে অনেক। পুজো সংখ্যাগুলোর আকার আয়তনও ঢের বেড়েছে।
১৯৩৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা পুজো সংখ্যা ছাপা হয়েছিল ৩৫ হাজার কপি। নি:শেষিত হতে সময় লেগেছিল মাত্রই কয়েকদিন।
পুরোপুরি তথ্য বিমুখ হয়ে ইদানীং কেউ কেউ যদিও দাবী করেন যে অধিকাংশ পাঠকরাই এখন পুজো সংখ্যা ছুঁয়ে দেখেন না। প্রকৃতপক্ষে বাণিজ্যিক বা অবাণিজ্যিক পত্র পত্রিকার পুজো সংখ্যার বিক্রি-বাট্টা এখনও খুবই উৎসাহজনক। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে এই বঙ্গদেশ ছাড়া দেশে বিদেশে অন্য কোথাও এরকম বিশেষ ঋতুকালীন অঢেল সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ হয় না।