বেলুরমঠের দুর্গাপুজা আরম্ভের ইতিহাস (নরেনের দুর্গাপুজা)
আমার কথা, বিশেষ প্রতিবেদন:
সংঘমিত্রা দাশগুপ্ত
স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০১ সালে বেলুড়মঠে দুর্গাপূজা শুরু করেন। সেই থেকেই বেলুড়মঠে দুর্গাপূজা শুরু হয়। আর সেই পূজোর মাত্র আট মাস পরেই ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দের ৪ঠা জুলাই স্বামীজী তাঁর নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন।
অনেক দিন ধরেই স্বামীজীর মনে এই ইচ্ছে ছিল যে তিনি বেলুড় মঠে দুর্গাপূজা করবেন। ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠার পর স্বামীজী প্রায়ই তাঁর প্রিয় বেলগাছতলায় বসে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে নিজের মনে একটি গান গাইতেন। সেই গানের কথাগুলো ছিল- ” বিল্ববৃক্ষতলে পাতিয়া বোধন/ গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন/ ঘরে আনব চণ্ডী, কর্ণে শুনব চণ্ডী/ আসবে কত দণ্ড, জটাজুটধারী।।”
এরপর একদিন ১৯০১ সালের মে-জুন মাসে স্বামীজী তাঁর গৃহী শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্ত্তীকে রঘুনন্দনের অষ্টবিংশতি তত্ত্ব বইটি কিনে আনার জন্য বলেন। তখন তাঁর শিষ্য তাঁকে জিজ্ঞেস করেন যে ওই বই নিয়ে স্বামীজী কি করবেন। তখন স্বামীজী বলেন যে এইবার তাঁর মনে দুর্গোৎসব করার ইচ্ছে আছে। তাই তাঁর দুর্গোৎসব বিধি পড়বার ইচ্ছে হয়েছে। গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী শিষ্য বইখানি স্বামীজীকে এনে দেন।চার-পাঁচ দিনের মধ্যে বইটি পড়া শেষ করে স্বামীজী তাঁর শিষ্যকে জানিয়েছিলেন যে বইটি তিনি পড়ে ফেলেছেন এবং তাঁর ইচ্ছে যে এবার মায়ের পূজো করার। এরপর পূজোর সময়ও এসে যায় কিন্ত তখনও পর্যন্ত পূজোর কোন ব্যবস্থাই হয়নি। পূজোর যখন আর মাত্র চার-পাঁচ দিন বাকি, তখন একদিন স্বামীজী কলকাতা থেকে বেলুড়ে ফিরেই রাখাল মহারাজকে বললেন যে এবার মঠে দুর্গোৎসব হবে তাই রাখাল মহারাজ যেন সমস্ত আয়োজন করতে শুরু করেন। পূজোর আর মাত্র চার-পাঁচ দিন বাকি, তার মধ্যে সব আয়োজন করা সম্ভব হবে কিনা, প্রতিমা পাওয়া যাবে কিনা এইসব কথা রাখাল মহারাজ স্বামীজীকে বলাতে তিনি বললেন যে তিনি ভাবচক্ষে দেখেছেন যে মঠে মা দুর্গার পূজো হচ্ছে। স্বামীজীর মুখে এই কথা শোনার পর রাখাল মহারাজ ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলালকে কলকাতার কুমোরটুলিতে প্রতিমার খোঁজ করতে পাঠালেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন যে মাত্র একটিই প্রতিমা রয়েছে। কিন্ত সেই প্রতিমাটি অন্য কেউ তৈরী করতে দিয়েছিলেন। অদ্ভুতভাবে যে বা যাঁরা প্রতিমা তৈরী করতে দিয়েছিলেন, তাঁরা তখনো পর্যন্ত প্রতিমা নিতে আসেননি। ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল এই কথা শুনে শিল্পীকে জিজ্ঞেস করলেন যে ওই প্রতিমা শিল্পী তাঁদের দিতে পারবেন কিনা। এই কথা শুনে সেই শিল্পী বলেন যে তিনি আর একটি দিন অপেক্ষা করে দেখতে চান।
ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল মঠে ফিরে গিয়ে স্বামীজীকে এই খবর দিলে স্বামীজী নির্দেশ দেন যে, যে ভাবেই হোক ওই প্রতিমা মঠে নিয়ে আসতে হবে। পরের দিন স্বামীজী কলকাতায় শ্রী শ্রী সারদা মায়ের কাছে দুর্গোৎসব করার অনুমতি চাইতে গেলেন। মা সানন্দে তাঁকে অনুমতি দিলেন, কিন্ত পশুবলি দিতে বারণ করলেন।
এরমধ্যে স্বামী প্রেমানন্দ কুমোরটুলিতে গিয়ে দেখলেন যে কেউ প্রতিমা নিতে আসেননি। তিনি তখন শিল্পীর সাথে কথা বলে প্রতিমা বায়না করে এলেন।
জানা যায় যে, সেইবার দুর্গাপূজো পড়েছিল কার্তিক মাসে। ১লা কার্তিক, শুক্রবার- ১৮ই অক্টোবর ছিল ষষ্ঠী। পঞ্চমীর দিন ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল, স্বামী নির্ভয়ানন্দ এবং আরো কয়েকজন ব্রহ্মচারী মিলে দুর্গাপ্রতিমা মঠে নিয়ে এলেন।ষষ্ঠ দিন সকালে বাগবাজার থেকে শ্রী শ্রী মা বেলুড়ে চলে এসেছিলেন। সন্ন্যাসীরা তো সর্বত্যাগী, তাই তাঁদের নামে তো পূজার সংকল্প হতে পারে না, তাই মায়ের নামেই পূজার সংকল্প করা হয়েছিল। স্বামীজীর প্রিয় বেলগাছতলায় বোধন অনুষ্ঠান হয়েছিল। মায়ের অনুমতি নিয়ে পূজো করতে বসেছিলেন ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল। আজও বেলুড় মঠের পূজায় মায়ের নামেই সংকল্প করা হয়।
বেলুড় মঠে অষ্টমীর দিন কুমারী পূজোর চল প্রথম থেকেই। কথিত আছে যে অষ্টমীর দিন কুমারী পূজো করার পর১০৮ টি পদ্ম মা সারদার পায়ে দিয়ে জ্যান্ত দুর্গার পূজো করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।