স্মার্ট ফোন কি সত্যিই আমাদের স্মার্ট করছে?
আমার কথা, বিশেষ প্রতিবেদন, ৩ ফেব্রুয়ারী:
সংঘমিত্রা দাশগুপ্ত
স্মার্ট বয় বা স্মার্ট গার্ল – এই শব্দগুলো শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একদম কেতাদুরস্ত পোশাকে সজ্জিত, ঝরঝরে ইংরেজি বলা একটি ছেলে বা মেয়ের চেহারা। এখন আবার তার সাথে সংযোজন হয়েছে আর একটি জিনিস। অবশ্যই তাদের হাতে থাকতে হবে একটি সুঠাম চেহারার ফোন -স্মার্ট ফোন। এই ফোন যার কাছে নেই, যে এখনো পকেট থেকে সেই ছোট্ট ফোনখানি বার করে, সে আজকের আধুনিক প্রজন্মের কাছে করুণার পাত্র।
এই ফোনের মধ্যে পুরো দুনিয়াটাকে ভরে দেওয়া হয়েছে। আজকের প্রজন্মের বিনোদনের জন্য যা যা দরকার সব এই ফোনের মধ্যে আছে। নৈতিক, অনৈতিক, ভালো, মন্দ, প্রাপ্তবয়স্ক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক – সবার জন্যই এখানে অফুরন্ত ভান্ডার। আর লকডাউনের কল্যাণে এই ফোন এখন কুলীনের গোত্র লাভ করেছে। কারণ লেখাপড়ার জন্য তখন সেই ছিল অন্ধের যষ্ঠি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে ফোন তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন অভিভাবকরা। একটা সময় ছিল যখন আমরা পড়ার বইয়ের তলায় গল্পের বই রেখে পড়তাম। আর এখন, একটি আঙ্গুলের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে পেজের পর পেজ, উঠে আসছে দেশ দুনিয়ার বিনোদনের সম্ভার। এখানে কনটেন্ট কি থাকবে, বা কতটুকু আপনার সন্তান দেখতে পাবে ,তা কন্ট্রোল করার ক্ষমতা আপনার নেই। স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে গোটা বিশ্ব ডাকছে হাতছানি দিয়ে। তার মধ্যে কিছু ভালো অবশ্যই আছে, কিন্তু এর বেশিরভাগই সেই কনটেন্টকেই প্রোমোট করে যার থেকে বিজনেস বেশি আসে, অর্থাৎ যা বেশি লাভের মুখ দেখায় এর সাথে যুক্ত বিভিন্ন কোম্পানীকে। আপনি হয়তো জানতেই পারলেন না যে আপনার সবে মাত্র কৈশোরে পা দেওয়া সন্তান তার জন্য উপযুক্ত কোন পেজে আসা বিভিন্ন লিংক ক্লিক করতে করতে পৌঁছে গেল নীল দুনিয়ায়।
সোশ্যাল মিডিয়া যেমন অনেক কিছু পজিটিভ দিক আমাদের দিকে তুলে ধরছে ঠিক তার উল্টো একটা ছবিও আছে। Brigham Young University এর একটি স্টাডি থেকে দেখা গেছে, দিনে ২/৩ ঘন্টা সোশ্যাল মিডিয়াতে বা ইন্টারনেটের দুনিয়াতে যে সমস্ত টিনএজাররা থাকে, তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে থাকে। এই এতক্ষণ যে ভারী ভারী কথাগুলো বললাম, সৌভাগ্যবশতঃ,সেগুলোর কোনটাই স্মার্ট ফোন মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করার পরেও অনেকের ক্ষেত্রেই হয় না – কিন্তু, যেটা অবশ্যই হয়, তা হলো মনঃসংযোগ বা মনোনিবেশ করার ক্ষমতা তাদের একেবারেই কমে যায়। একটু দেখে নেওয়া যাক যে এই মনঃসংযোগ বা concentration ব্যাপারটা কি? মনঃসংযোগ মানে কোন একটি বিশেষ সময়সীমার মধ্যে যে কাজ করা হচ্ছে সেখানে সর্বান্তকরণ প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানসিক ভাবে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে যুক্ত হয়ে থাকা। কিন্তু এই নিরবিচ্ছিনতাকে বিচ্ছিন্ন করা অর্থাৎ আমাদের distract করার কাজটা সব থেকে বেশি কে করে? এই ব্যাপারে অবশ্যই সোস্যাল মিডিয়া, ই-মেল, সেলফোন এবং ইন্টারনেট হচ্ছে সব থেকে বড় চোর। এক রাত ঘুম না হলে বা অতিরিক্ত নেশাগ্রস্ত হলে পরের সারাদিন কোন কাজে মনোনিবেশ করা যায় না বা করতে কষ্ট হয়। কিন্তু একটি সমীক্ষা বলছে এর থেকে কয়েকগুণ বেশি মনঃসংযোগ নষ্ট করে অতিরিক্ত সোস্যাল মিডিয়ায় অথবা ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ব্যস্ত থাকা। একবার যদি আমাদের মনঃসংযোগকে এদের মধ্যে কেউ কাটতে পারে, তাহলে তখন আমাদের ফোকাস পুরোটাই নিয়ে নেয় সেই সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়া আর প্রকৃত ফোকাসের জায়গাটা আমাদের মেমরিতে পিছনে চলে যায়। Concentration বা মনঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনা আমাদের সেই কাজের ফলাফলকে নেগেটিভ অর্থে প্রভাবিত করে। আশ্চর্য লাগলেও, ইউনিভার্সিটি অব্ ক্যালিফোর্নিয়ার Irvine স্টাডি বলছে যে একবার কোন কাজের থেকে মনঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে, গড়ে ২৩ মিনিট ১৫ সেকেন্ড লাগে সেই কাজে মনঃসংযোগ করতে। ২৩ মিনিট ১৫ সেকেন্ড সময়টা কিন্তু শুনতে এইটুকু মনে হলেও আসলে সময়টা কম নয়। স্মার্ট ফোনের মেসেজ আসার ছোট্ট টুং শব্দটাও মনঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য যথেষ্ট। শুধু একবার পড়ার বই থেকে চোখ তুলে স্মার্ট ফোন দেখে আবার পড়ায় মন দেওয়া কিন্তু আসলে আবার সেই ২৩ মিনিটের গল্প। তার মানে যতবার আমরা distract হচ্ছি, ততবার আমরা আমাদের যে লক্ষ্য সেখান থেকে অনেকটা, মানে সত্যিই অনেকটা পিছিয়ে যাচ্ছি। আবার সেই শুরু থেকে শুরু করতে হচ্ছে। বারবার যদি আমরা স্টার্টিং পয়েন্টে ফিরে যাই, তাহলে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাবো কি করে? স্মার্ট ফোন আমাদের এগিয়ে দেওয়ার থেকে বরং পিছনের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে বেশি। তবে এখানে তার থেকেও বড় বিপদের কথা যে, এই পিছিয়ে যাওয়াটা আমরা সেই মুহূর্তে বুঝতে পারি না। আর যখন বুঝতে পারি, তখন সত্যিই আর কিছু করার থাকে না কারণ তখন আমরা আমাদের ব্রেনকে অভ্যস্ত করে দিয়েছি স্মার্ট ফোনের দুনিয়াতে ঘুরে বেড়াতে – যেখানে প্রোডাক্টিভিটি শূন্য। চিন্তা করে দেখুন আপনার অবসর সময়ে আপনি উদ্দেশ্যহীন ভাবে এলোমেলো নেট সার্ফিং করতে থাকেন, তাহলে কয়েকঘন্টা পরে দেখবেন যে মানসিকভাবে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন কিন্তু প্রোডাক্টিভিটি শূন্য। স্মার্ট ফোনের দৌলতে, আমরা আমাদের পছন্দ মুহুর্মুহু বদলাতে থাকি, ঠিক যেমন আমরা রিমোট হাতে টিভির চ্যানেল বদলাই। আমাদের মন এক জায়গায় স্থির হবার সময় বা সুযোগ পায় না, যার প্রতিফলন সেই মানুষটির ভবিষ্যত জীবনের সব কাজের মধ্যে পড়ে। এই concentration যে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা স্বামী বিবেকানন্দর একটি উক্তি থেকে বোঝা যায় – “The difference between an ordinary person and a great person lies in the degree of concentration”। একটা গল্প দিয়ে শেষ করা যাক। মহাদেব ভস্মাসুরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বরদান করলেন যে ভস্মাসুর যার মাথায় হাত রাখবে, সেই ভস্ম হয়ে যাবে। ভস্মাসুর তো সেই বর পেয়ে প্রথমেই মহাদেবের মাথায় হাত রাখার জন্য উদ্যত হলো। মহাদেব নারায়ণের সাহায্য চাইলেন। নারায়ণ মোহিনী নারীর রূপ ধরে ভস্মাসুরকে তাঁর রূপে মুগ্ধ করে মোহিনী নৃত্যের মধ্যে দিয়ে ভস্মাসুরকে নিজের মাথায় হাত রাখিয়ে ভস্ম করে দিয়েছিলেন। আমাদের কাছে বিজ্ঞানের বরদান স্মার্টফোন। স্মার্ট ফোনের মোহিনী মায়ায় নাচতে নাচতে ভস্মাসুরের মতো আমরাও যেন নিজেদের বিনাশ নিজেরাই ডেকে না আনি!!!