রাজুর খালাসি থেকে মাফিয়া ডন হওয়ার কাহিনীতে খোঁজ মিললো বিপুল সম্পত্তির
আমার কথা, দুর্গাপুর, ২ এপ্রিলঃ
রাজেশ ওরফে রাজু ঝা যিনি ব্যবসায়ী বলে পরিচিত হলেও একদা কুখ্যাত কয়লা মাফিয়াদের শীর্ষে ছিলেন। সেই রাজু ঝায়ের খুনের ২৪ ঘন্টা কাটতে না কাটতে শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুরের আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে নানা কথা। উঠে আসছে নানা তথ্য। যার মধ্যে রাজেশ ঝা কি করে রাজু ঝা হয়ে উঠল, কিংবা তার বিপুল সম্পত্তির নেপথ্য কাহিনী।
শুরু করা যাক রাজেশ ঝায়ের রাজু ঝা হয়ে ওঠার কাহিনী দিয়ে। সুত্র মারফত জানা গিয়েছে বহুকাল আগে যখন রাজু ছোট ছিলেন সেই সময় বাবা মায়ের হাত ধরে বিহারের দ্বারভাঙা থেকে রানীগঞ্জে এসে ওঠেন। রানীগঞ্জের পাঞ্জাবী মোড়ে ১৯ নং জাতীয় সড়কের ধারে রয়েছে ৬ ও ৭ নং কলোনী। এই কলোনীতেই সেই সময় নিজেদের বাড়িতে থাকতেন রাজু। রানীগঞ্জের মারওয়ারী স্কুলে ভর্তি করে দেন বাবা। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত্য পড়াশুনা করে সেই পাট চুকিয়ে তখনই ঢুকে পড়েন কয়লা কারবারে। ৮০-৯০ দশকে তৎকালীন কয়লা মাফিয়া রজু উপাধ্যায়ের পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় এই রাজু। প্রথমদিকে কয়লার ট্রাকের খালাসি হিসেবে কাজ শুরু করলেও পাশাপাশি কয়লা কারবারে হাত পাকাতে শুরু করেন। ফলে খালাসি থেকে কিছুদিনের মধ্যেই অবৈধ কয়লা কারবারের কালো জগতের সমস্ত অলিগলিতেই অবাধ বিচরণ শুরু করে দেন তিনি। ফলে হাতে আসে ক্ষমতা, বাড়তে থাকে দাপট। এরই মধ্যে মৃত্যু হয় সরজুর। আর তখন অলিখিতভাবে সরজুর ব্যবসার বেতাজ বাদশা হয়ে ওঠে এই রাজু ঝা। ২০০০ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত তাঁর কয়লার কারবার রীতিমতো ফুলেফেঁপে ওঠে। রানিগঞ্জ থেকে ডানকুনি পর্যন্ত একচেটিয়া কয়লার প্যাড তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। কয়লার কালো কারবারে হাত পাকিয়ে রাজু হয়ে ওঠে ‘ব্যবসায়ী’। ২০১৫-১৬ সাল নাগাদ রানিগঞ্জ ছেড়ে পরিবার নিয়ে রাজু পাড়ি দেয় দুর্গাপুরে।
এবার নজর দেওয়া যাক রাজু ঝায়ের বিশাল সম্পত্তির দিকে। রানীগঞ্জ ছেড়ে দুর্গাপুরের বিধাননগরে প্রাসাদোপম বাড়ি বানান রাজু। দুর্গাপুরে এলে সেই বাড়িতেই উঠতেন তিনি। সেই বাড়িতে রাজুর বড় ছেলে থাকেন। বিহারে রয়েছে রাজুর আরো একটি বাড়ি, যেই বাড়িতে রাজুর স্ত্রী ও ছোট ছেলে থাকেন। এর পাশাপাশি ই-এম বাইপাসে ও বাগুইয়াঁটিতে আরো দুটি ফ্ল্যাট আছে এই কালো হীরের কারবারির। দুর্গাপুরে একটি সিকিউরিটি এজেন্সিও চালাতেন তিনি। সিটিসেন্টারে একটি বড় হোটেলও তৈরী করেন তিনি যেখানে বিভিন্ন তলে বহু নামী সংস্থার ফ্রাঞ্চাইজারকে শোরুম ভাড়া দেওয়া আছে। এছাড়াও বিধাননগরে একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে, ডিএসপি টাউনশিপে একটি গেস্ট হাউস লিজে নেওয়া আছে। দুর্গাপুর বাসস্ট্যান্ডে একটি পরিবহন দপ্তর ছিল যা আপাতত বন্ধ রয়েছে, সেখান থেকে ভলভো বাস চলতো। তবে পাশাপাশি এই জেলায় কয়লা পাচার, গাঁজা পাচার, বেআইনি অস্ত্র রাখা, তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। কয়লা পাচারের অভিযোগে ২০১১ সালের ৩ জুলাই রাজুকে গ্রেফতার করেছিল রানিগঞ্জ থানা। ২০১৪ সালের ২৬ মে ফের কাঁকসা থানার হাতে তিনি ধরা পড়েন। ২০১৫ সালের ৬ মে কাঁকসায় কয়লা চুরির অভিযোগে গ্রেফতার। ২০১৬ সালের জুন মাসেও কাঁকসা থানার পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তিন মাস পর জামিনে ছাড়া পেয়ে ভিনরাজ্যে চলে গিয়েছিলেন রাজু। এর পর ২০১৬ সালে ৬ ডিসেম্বর বাগুইআটি থেকে টাকা পাচারের অভিযোগে ফের রাজুকে গ্রেফতার করে এসটিএফ ।
প্রপ্সঙ্গতঃ ২১ ডিসেম্বর ২০২০ দুর্গাপুরে একটি সভাতে লক্ষণ ঘোড়ুই ও দিলীপ ঘোষ এবং সাংসদ অর্জুন সিংয়ের হাত ধরে বিজেপিতে যোগদান করেন এই কয়লা মাফিয়া। বিজেপি-র প্রচারেও অংশ নেন তিনি। এমনকী ভোটে তাঁকে দলের তরফে টিকিট দেওয়া হতে পারে বলেও ছড়ায় জল্পনা। যদিও শেষ পর্যন্ত টিকিট দেওয়া হয়নি। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কয়লা পাচারের অভিযোগে বাঁকুড়া থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে সিআইডি। সেই মামলায় জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আর রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় ছিলেন না রাজু।
সুত্রের খবর, বীরভুমে গরু পাচারকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত আব্দুল লতিফ বীরভূমের কয়লা কারবার দেখতেন। সেই সূত্রে লতিফের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল রাজুর। কয়লাকাণ্ডে তাঁর বয়ান রেকর্ড করার জন্য সোমবার ডেকে পাঠিয়েছিল এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট। শনিবার সন্ধ্যায় পূর্ব বর্ধমানের শক্তিগড়ে দুষ্কৃতিদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান রাজু। এদিকে যে গাড়িতে তিনি ছিলেন সেটি আবার গরু পাচার চক্রের অন্যতম পাণ্ডা এই আব্দুল লতিফের বলে জানা যাচ্ছে। যা নিয়েও ঘনাচ্ছে রহস্য। তাঁর মৃত্যুতে ইতিমধ্যেই সিবিআই তদন্তের দাবি করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।