আর্য ঋষি ও শিল্পীদের কল্পনায় সরস্বতী নদী হয়েছেন দেবী সরস্বতী
আমার কথা, বিশেষ প্রতিবেদন, ২ ফেব্রুয়ারীঃ
লেখকঃ প্রণয় রায়
সরস্বতীর বিদ্যার ঝাঁপি থেকে কিছু ফুল দিয়ে দেবী সরস্বতীকে অঞ্জলি দিলাম। বেদে সরস্বতীকে কোথাও আবাহন করা হয়েছে দেবিতমে বলে কোথাও অম্বিততমে রূপে কোথাও বা নদীতমে অভিধায়। দেবীতমার অর্থ দেবী শ্রেষ্ঠা, অম্বিতমার অর্থ মাতৃ শ্রেষ্ঠা আর নদীতমার অর্থ নদী শ্রেষ্টা । অর্থাৎ তিনি দেবী তিনি মা তিনি নদীরূপা। ঋকবেদে অন্যতম প্রসিদ্ধ বেদ ভাষ্যকার সায়ন আচার্য বলেছেন দ্বিবিধা হি সরস্বতী বিগ্রহবদ্দেবতা নদীরূপা চ। অর্থাৎ তার মতে সরস্বতী দ্বিবিধা। বিগ্রহবতী দেবী রুপা এবং তোয়বতীও গতি নদীরূপা। দশম ঋকে সরস্বতীকে বলা হয়েছে পাবকা। অর্থাৎ যিনি পাপকে শোধন করেন। যিনি পাপনাশিনী ও পতিতপাবনী।
উত্তরাখন্ডের চামোলি জেলার বদ্রীনাথ মন্দির থেকে চার কিলোমিটার দূরে ভারতের প্রথম গ্রাম মানা । হিমালয়ের চামোলী জেলায় অবস্থিত এই গ্রামের কাছেই বদরীনাথ ধাম। এই গ্রামটিকে দেবতাদের গ্রাম বলা হয়। বলা হয় পঞ্চপান্ডব এখান থেকেই মহাপ্রস্তানের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন। এই মানা গ্রামেই মহর্ষি ব্যাসদেব চতুর্বেদ, মহাভারত সহ ১৬ টি পুরান রচনা করেছিলেন।
এই মানা গ্রামেই সৃষ্টির উষাকালে ব্রহ্মার মুখ থেকে আবির্ভূত হন জ্ঞান-বিদ্যা সঙ্গীত ও শিল্পকলার দেবী সরস্বতী বলে প্রচলিত বিশ্বাস। তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন নদীরূপে। সুমহান ভারতবর্ষে আর্য সভ্যতার সূচনা হয়েছিল সরস্বতী নদীর তীরে। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল ছিল বদ্রিনাথ এর কাছে একটি হিমবাহ থেকে। মানা গ্রামের পেরিয়ে কেশবপ্রয়াগে অলকানন্দা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। আবার সুপ্রাচীন কাল থেকে পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে সরস্বতী নামে এক পবিত্র দোয়া নদীর অস্তিত্ব পাওয়া যায় যে নদী পাঞ্জাবের ভূখণ্ড ব্যাপী প্রবাহিতা এবং এর অববাহিকায় প্রচুর শস্য উৎপন্ন হতো এবং আর্যদের জননীর স্নেহে পালন করতেন। এরই উপকূলবর্তী ভূখণ্ডে ব্রহ্মাবর্ত ভূমিতে বিকশিত হয়েছিল আর্য আর্য ধর্ম ও আর্য সংস্কৃতি । বেদ ঋষিরা সরস্বতী নদীর তীরে পর্ণ কুটিরে বাস করতেন।তারা এখানে বেদের স্তোত্র রচনা করতেন, বেদ পাঠ করতেন ও বীণা বাজিয়ে বেদ সংগীত গাইতেন। আবার আমরা এক পুরানে পাই হিমালয়ের পদদেশে মানা গ্রামে সরস্বতী নদী তীরে বাস করতেন মহর্ষি ব্যাসদেব। সরস্বতী নদীতে নিয়মিত স্নান করতেন মহাভারত রচয়িতা ব্যাসদেব। তাঁর মহাভারত রচনার লিপিকার ছিলেন গনেশ। ব্যাস দেবের গুম্ফা, গনেশদেবের গুম্ফা, সরস্বতী মন্দির ও হিমালয়ের দুর্গম হিমবাহ থেকে পাহাড়ের পাথরের খাঁজ দিয়ে প্রচন্ড গতিতে প্রবাহিত একঝলক সরস্বতী নদীকে আজও মানা গ্রামে গেলে দেখা যায়।
বেদজ্ঞ আর্য ঋষিরা
নদী সরস্বতীকে দেবী সরস্বতী রূপে আরাধনা করতেন। আর্যাবর্তে প্রবাহিত সরস্বতী নদীর তীরবর্তী
উপকূলে ব্রহ্মাবত্ত ভূমিতে হত অগণিত আর্য কন্ঠে নিত্য সাম গান। হত নিরন্তর বেদানুশীলন। জ্বলতো হোমশিখা। উঠতো প্রণবধ্বনী। তাদের এই আরণ্যক জীবনে আর্য ঋষিরা পবিত্র তোয়া সরস্বতী নদী তীরে সংসার বিমুখ হয়ে যোগ ও ধ্যানে নিবিষ্ট থাকতেন। সরস্বতী নদী বিধৌত এই পুণ্যভূমিতেই আর্য ধর্ম ও আর্য সংস্কৃতি ও আর্য সভ্যতার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ। এখানেই ফুটেছিল প্রথম আলো যে আলোতে আজও আমরা ধ্রুব কল্যাণের পথ চিনে নিতে পারি। ভবিষ্যতেও পারবো।এখানেই মানুষ পেয়েছিল তার মূক কণ্ঠে প্রথম ভাষা। সে ভাষা সে সংগ্রহ করেছিল অনাহত প্রণব সংগীত থেকে। উচ্ছ্বাসময়ী সরস্বতীর জলকল্লোল তাকে প্রণোদিত করেছিল বাঙ্ মুখরিত হতে। বস্তুত দেবী সরস্বতী ও নদী সরস্বতী উভয়ই অভিন্ন আত্মা। দেবী রূপেও তিনি আমাদের মা নদী রূপেও তিনি আমাদের মা।
বৈদিক যুগে নদীর সরস্বতী ছিল দেবী সরস্বতীর স্থূল বিগ্রহ।
আর্যরা নদী সরস্বতী কে দেবী সরস্বতী রূপে পুজো করতেন। সরস্বতী নদী তীরে বসেই সাম গান, বেদ স্তোত্রপাঠ ছাড়াও এই নদীর জলই তাদের জীবনধারণের উপকরণ। এখানেই তারা জীবন নির্বাহ করতেন। কিন্তু একদিন তাদের সন্তান-সন্ততিরা বাড়তে শুরু করল। নদী সরস্বতীর তীরে তাদের থাকবার জায়গা সংকুলন হলো না। তখন তারা ছড়িয়ে পড়লেন পুণ্যভূমি ভারতবর্ষের নানান দিকে।তখন নদী সরস্বতীর রূপ দেবী সরস্বতীর রূপে কল্পনা করে দেবী আরাধনার আর সুযোগ রইলো না। তাই আর্য ঋষিরা আর্যাবর্তের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ার আগে নদী সরস্বতী কে দেবী সরস্বতী রূপে তাদের হৃদয় প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন। সাধক ও শিল্পীর শুদ্ধ মনন শক্তির সিদ্ধি স্বরূপে দেবীর অপরূপ মূর্তি বৈভবের প্রকাশ হয়। সরস্বতী নদীর জল নিষ্কলঙ্ক পবিত্র তাই দেবীর রূপ কল্পনা করা হয় শ্বেত শুভ্র। আর্য ঋষিরা বীনা বাজিয়ে সাম গান করতেন।তারা সেই বীনাকে দিলেন দেবীর হাতে। সরস্বতী নদীর তীরে বসে ভুজ্য পত্রে লেখা হতো বেদ, পুরাণ, মহাভারত আরো কত কিছু। তাই দেবীর হাতে দেওয়া হলো সেই পুস্তক। দেবি হলেন পুস্তকশ্রী। সরস্বতী নদী জলে অজস্র পদ্মফুল ফুটে থাকতো। তাই দেবীকে বসানো হলো পদ্ম ফুলের আসনে। সরস্বতী নদীর জলে ঘুরে বেড়াতো অসংখ্য
রাজ হাঁস। তাই তার বাহন হল রাজহংস। শিল্পী ও সাধকের কল্পনার সেই দেবী সরস্বতীর মূর্তি এখন ঘরে ঘরে পূজা করা হয়। দেবী সরস্বতীর জ্যোতির্বেতা এবং নদী সরস্বতীর নিষ্কলুষ স্বচ্ছতা এই দুইয়ের সমন্বয়ে দেবী হন শ্বেতবর্ণা। তার বসন, ভূষণ ও বাহনেও ওই রং লেগে যায় তিনি হন সর্বশুক্লা।
মানা গ্রামে সরস্বতী নদী কে আরও একবার দেখলাম আর ভাবলাম এই সরস্বতী নদীর তীরেই হয়তো একদিন আর্য সভ্যতা আর ও বিকশিত হয়েছিল। নদীর পাশেই দেবী সরস্বতীর মন্দির। প্রকৃতি এখানে কি অপরূপ সৌন্দর্য বিলিয়ে চলেছে চারদিকে। নিভিষ্ট হয়ে সবকিছু দেখছিলাম আর ভাবছিলাম একদিন বেদ ঋষিরা এখানে ছিলেন। এই পবিত্র সরস্বতী নদীর তীরে প্রতিদিন ধ্বনিত হতো সাম গান হতো শিষ্যগণ পরিবৃত আচার্য কন্ঠে নিরন্তর বেদ অনুশীলন, জ্বলতো হোমশিখা,,উঠতো প্রণবধ্বনি। আরণ্যক জীবনে আর্য ঋষিরা সংসারভোগ বিমুখ হয়ে ব্রহ্মের ধ্যানে নিবষ্ট রইতেন। সত্য বলতে কি এই সরস্বতী বিধৌত এ পুণ্যভূমিতেই আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঘটে ক্রমবিকাশ।এখানেই ফুটেছিল পৃথিবীর প্রথম আলো যে আলোকে আজও আমরা ধ্রুব কল্যাণের পথ ভবিষ্যতেও পারবো যে আলোক চির অনির্বাণ । শুধু তাই নয় মানুষ এখানেই পেয়েছিল তার কণ্ঠে প্রথম ভাষা, যে ভাষা সে সংগ্রহ করেছিল প্রণব সংগীত থেকে। উচ্ছাসময়ী সরস্বতীর জলকল্লোল নাদ ও তাকে প্রণোদিত করেছিল বাঙমুখরিত হতে। বস্তুত দেবী সরস্বতী এবং নদী সরস্বতী উভয়েই অভিন্ন আত্মা। দেবী রূপে ও তিনি আমাদের মা নদী রূপে ও তিনি আমাদের মা। তিনি বিদ্যাদায়িনী দেবী সরস্বতী।
পরিবৃহীত করেছেন বিনা বাজিয়েছেন এখানে ব্যাসদেব বসে বসে মহাভারত পুরান কত কিছু রচনা করেছেন এখান থেকে রচিত হয়েছে বেদ। আর এখান থেকেই নদী সরস্বতী আর্য ঋষি ও শিল্পীদের কল্পনায় হয়েছেন দেবী সরস্বতী।
দেবী সরস্বতীর জ্যোতির বিভূতি এবং নদী সরস্বতীর নিষ্কলুষ স্বচ্ছতা এ দুই এর সমন্বয়ে দেবী হন শ্বেতবর্ণা,তিনি হন সর্বশুক্লা।