অথ নিষ্পেষণ কথা
আমার কথা, বিশেষ প্রতিবেদন, ১৬ মার্চ:
সংঘমিত্রা দাশগুপ্ত
“স্ট্রেস”- একটা ছোট্ট কিন্তু খুব পরিচিত শব্দ।শুধু থিয়োরি হিসেবে নয়, মোটামুটি আমরা সবাই এই শব্দটার সাথে প্র্যাকটিক্যালি পরিচিত। পরিচিত হওয়া আর তার সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞান থাকা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো আঙ্গিক। ব্যক্তিগত জীবনে স্ট্রেস নামক শব্দটার সাথে পরিচিত থাকলেও , সেরকম কোন ধারণাই ছিল না। বেশ কয়েক বছর আগে রোটারী ক্লাব অব দুর্গাপুর স্মার্ট সিটির পরিচালনায় “স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের” একটি সেমিনারে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। অনুষ্ঠানের বক্তা ছিলেন দু’জন – ডক্টর ইমন পাল এবং ডক্টর দেবাশিষ ঘোষ।
ডক্টর ইমন পালের বক্তব্যে জেনেছিলাম যে শুধু বড়রা নয়, স্ট্রেসে আক্রান্ত নার্সারীর বাচ্চারাও। জানতে চাইলাম যে বাচ্চাদের তো ওই বয়সে কোন perception সেই অর্থে তৈরী হয় না, তাহলে তারা স্ট্রেসড হয় কী করে ? এই কাজটা মূলতঃ করে থাকেন কাদের বাবা-মায়েরা। ছেলে বা মেয়েকে ইঁদুর দৌড়ে সামিল করার চক্করে তাঁরা স্ট্রেসের মতো স্লো পয়জন বাচ্চাকে দিয়ে দেন। স্ট্রেস আমাদের জীবনে অনেকটা স্লো পয়জনিং এর মতো কাজ করে। হয়তো কোন লক্ষণ নেই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে আমাকে শেষ করছে। স্ট্রেস এর প্রধান কারণ হলো না পাওয়া- অর্থাৎ আমি যা চাইছি সেটা পাচ্ছি না বা সেইমতো ঘটনা ঘটছে না। চাওয়া পাওয়ার ব্যালান্স রাখার খেলাই হলো স্ট্রেস। ডক্টর ইমন পালের বক্তব্যের কতগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ অথচ আমরা করি না, সেরকম কিছু বিষয় তুলে ধরলাম –
১. রাগকে নিজের বশে আনা , রাগের বশে নিজে না যাওয়া।
২. “না” বলতে শেখা।
৩. যা পছন্দ নয়, সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে আনা।
৪. নিজের সঙ্গকে উপভোগ করা এবং প্রত্যেকদিন নিজের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো।
৫. নিজের অনুভূতি (বিশেষ করে যা আপনাকে স্ট্রেস দিচ্ছে) অন্যের সাথে আলোচনা করা।
৬.জীবনে এমন goal সেট করা যা বাস্তবায়নের যোগ্য।
৭. পরিস্থিতির সাপেক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
আজ ডক্টর পালের একটা কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের জন্য – সেটি হলো , অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কিছু জিনিস, কিছু সিদ্ধান্ত সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো – Accept life as it comes.
এরপর বক্তব্য রাখেন সেদিনের অনুষ্ঠানের মূল বক্তা ডক্টর দেবাশিষ ঘোষ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের স্ট্রেসের সাথে স্পিরিচুয়াল জগৎ, কসমিক জগৎ এবং অবশ্যই বিজ্ঞানের যোগাযোগকে তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বোধগম্য করে তোলেন।
ডক্টর দেবাশিষ ঘোষ এর কথায় বুঝেছিলাম যে স্ট্রেস এবং মানসিক অবসাদ এক জিনিস নয়। বলা যেতে পারে স্ট্রেস হল কারণ আর মানসিক অবসাদ তার পরিণতি। ডক্টর ঘোষ আমাদের প্রশ্ন করেছিলেন যে স্ট্রেস এর কারণে কী কী রোগ হতে পারে বলে আমাদের ধারণা আছে। মোটামুটি সকলের উত্তর ছিল হাই প্রেশার, ডায়বেটিস, স্কিন প্রবলেম ইত্যাদি। আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে ডক্টর ঘোষ জানালেন যে অনিয়ন্ত্রিত স্ট্রেস ক্যান্সার এরও জন্ম দিতে পারে এবং এটি প্রমাণিত। মেন্টাল স্ট্রেস ক্যান্সার সেল তৈরী হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও নষ্ট করে দেয় স্ট্রেস। রীতিমতো বিজ্ঞানভিত্তিক কারণ আছে এই সবকিছুর নেপথ্যে।
ডক্টর ঘোষ এর মতানুযায়ী একটি সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে ৯৯ শতাংশেরও বেশী লোক মানসিক চাপের শিকার।অর্থাৎ আমরা প্রায় সবাই। এই স্ট্রেস মানুষকে দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নিতে পারে। Social এবং Physical সমস্যাকে যদি বাদও দেওয়া হয়, কিন্তু মানসিক সমস্যাকে কোন ভাবেই অবহেলা করা যায় না বা উচিৎ না। নেগেটিভ চিন্তা, নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা, মরে যেতে বা পালিয়ে যেতে চাওয়া, নিজের রাগ চরিতার্থ করার জন্য অন্যের ক্ষতি করা- এই সবই স্ট্রেসের জন্য সৃষ্টি মানসিক সমস্যা।
এর থেকে মুক্তির উপায় অবশ্যই আছে। কিন্তু সবচেয়ে আগে নিজেকে জানতে হবে এবং মানতে হবে যে আমি মানসিক চাপের শিকার। আমাদের সাব্ কনশিয়াস মাইন্ড বা তৃতীয় নয়নের এই ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা আছে যদি আমরা তাকে জাগাতে পারি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা প্রায় ৯৯.৯৯% ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারে অসমর্থ হই। মেডিটেশন হচ্ছে একমাত্র সেই পদ্ধতি যার সাহায্যে আমরা আমাদের ঘুমিয়ে থাকা মনকে জাগিয়ে তুলতে পারি। সেই অবস্থায় আমি নিজের সম্বন্ধে যা কিছু ভালো বলবো সেটাই হবে। আমরাই পারি, আবার আমরাই পারি না। আরও একটি বিষয় ভালো করে জানলাম। যেহেতু আমাদের শরীরের ৭০ ভাগ জল, তাই ভালো আর খারাপ চিন্তার সাথে সাথে শরীরের ভেতর গঠনগত পরিবর্তন চলতে থাকে এবং তার জন্যই কেউ ক্যান্সার এর মতো রোগে আক্রান্ত আবার কেউ সর্বাঙ্গীন সুস্থ। এটা বোধহয় আপনারা অনেকেই জানেন যে বিভিন্ন গ্লাসে জল রেখে তার গায়ে ভালো বা খারাপ শব্দ লিখে ,তারপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে যেখানে ভালো কথা লেখা হয়েছে তার মলিকিউলার স্ট্রাকচার , যেখানে খারাপ কথা লেখা হয়েছে তার থেকে অনেক সুন্দর এবং ইতিবাচক।
আর শেষে একটা কথা- স্ট্রেস হওয়ার আর একটি প্রধান কারণ যে কোন জিনিস অতিরিক্ত হওয়া – প্রয়োজনের বেশী যে কোন জিনিসই বিষ- সে যদি ভালবাসা হয় তাও। অতিরিক্ত ভালোবাসা possessive করে দেয়, যা থেকে অনেক অপরাধ তৈরী হয়। তাই অতিরিক্ত কোন কিছু দেওয়া বা নেওয়া মানসিক চাপকে ডেকে আনতে পারে।
তাই মেডিটেশনের মাধ্যমে নিজেকে কসমিক জগতের সাথে সারা দিনে অন্তত ১০ মিনিটের জন্য ডুবিয়ে দিতে পারলেও স্ট্রেস থেকে অবশ্যই মুক্ত থাকবেন বলেই ডক্টর ঘোষ এর মত।
সব শেষে বলি –
হাসুন – কারণে অকারণে
নতুন কিছু try করুন, তা সে অন্যের যতই বোকা বোকা লাগুক
ভালো ঘুমান
শরীর চর্চা করুন
খোলা বাতাসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিন
“না” বলতে শিখুন, সবার প্রিয় হবার দরকার নেই
কাঁদতে শিখুন, শক্ত মানুষই কাঁদে, দুর্বলরা কাঁদতে পারে না আর লাস্ট বাট মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট নিজেকে ভালবা